** আসিফ মইন নামের করদাতার বেতন ও ডিভিডেন্ট হিসেবে প্রায় তিন কোটি টাকার কর হাওয়া, ১২টি চালান জালিয়াতি, চালানের পরিবর্তে টপশীটে চালান নম্বর লেখেন কাজল মোল্লা
** ফারইষ্ট নিটিংয়ের তিন কর্মকর্তার করফাইল থেকে করের প্রায় ২০ কোটি টাকা সরিয়েছেন কাজল মোল্লা
** এপিএস গ্রুপের শামীম রেজা ও ইনা রেজার ফাইল সার্কেল থেকে সরিয়ে মূল ফাইল নষ্ট করা হয়েছে
** শামীম রেজা ও ইনা রেজার কর নথি জালিয়াতি করে প্রায় ২০ কোটি টাকার নগদ টাকা ও সম্পদ বৃদ্ধি করেছে
** জালিয়াতিতে কাজল মোল্লাকে সহযোগিতা করেছেন কর পরিদর্শক মো. আব্দুল বারী ও কয়েকজন কর্মচারী
** কাজল মোল্লার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে আয়কর গোয়েন্দা, করফাইলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ
** ডিপিডিতে কাজল মোল্লার ২৬টি মিটারের সন্ধান, অনুসন্ধান করছে আয়কর গোয়েন্দা
** কয়েকটি কর অঞ্চলে বড় করদাতাদের ফাইল দেখাশোনার নামে বিপুল জালিয়াতি করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে
ছিলেন একটি কর অফিসের কর্মচারী (অস্থায়ী নাইট গার্ড)। তেমন শিক্ষাও নেই, লিখতে পারে না। অপকর্মের কারণে চাকরি চলে যায়। তবে এই চাকরি চলে যাওয়ায় কপাল খুলে যায় এই কর্মচারীর। হয়ে উঠেন ‘জালিয়াত’। বড় বড় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকদের আয়কর ফাইল ‘দেখাশোনার’ দায়িত্ব নেন। নিজে আইনজীবী না হয়েও করদাতা থেকে করের কথা বলে বছরে কোটি কোটি টাকা নিয়ে আসতেন। কিন্তু সেই টাকার নামমাত্র অংশ ‘চালানে’ রাজস্ব কোষাগারে জমা দিতেন। বাকি টাকা জমা না দিয়ে মেরে দিতেন। এভাবে করের কোটি কোটি মেরে হয়ে উঠেন ‘ট্যাক্স গডফাদার’। জাল চালান বানিয়ে করদাতাকে দিতে, যা করফাইলেও থাকতো। জালিয়াতি এখানেই শেষ নয়। সার্কেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় ‘পুরো করফাইল’ সার্কেল থেকে বাইরে নিয়ে যেতেন। মূল ফাইল নষ্ট করে নতুন করে করদাতার ‘সম্পদ বৃদ্ধি’ করে ফাইল জমা দিতেন। এমন জালিয়াতি করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দুই ফাইলে অন্তত ২০ কোটি টাকা নগদ অর্থ সংযোজন করেছেন। এক, দুইজন নয়-অসংখ্য করদাতাকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপদে ফেলেছেন এই মহাজালিয়াত। তার নাম মো. শাহাদাত হোসেন কাজল মোল্লা। আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন জালিয়াতি সামনে এসেছে। অনুসন্ধানে কাজল মোল্লার বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। জালিয়াতির একটি তদন্ত প্রতিবেদন বিজনেস বার্তার হাতে রয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে, একটি কোম্পানির তিনজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফাইলে ‘চালান জালিয়াতি’ করা হয়েছে। যাতে জরিমানাসহ করফাঁকি বের হয়েছে প্রায় ২২ কোটি ২৪ লাখ। ১৩ করবর্ষে এই ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। তবে কোম্পানি বলছে, কাজল মোল্লা প্রতিবছর তাদের থেকে করের কথা বলে এই টাকা নিয়ে এসেছেন। আয়কর গোয়েন্দার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসার পর এই তিন করদাতাদের পক্ষ থেকে কাজল মোল্লার বিরুদ্ধে থানায় পৃথক সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। অপর একটি গ্রুপ অব কোম্পানির দুইজন করদাতার ফাইল কাজল মোল্লা সার্কেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় বাইরে নিয়ে আসেন। মূলফাইল নষ্ট করে টাকা নগদ টাকা ও সম্পদ বৃদ্ধি করে নতুন ফাইল জমা দিয়েছেন। এতে মোল্লা নিজেও মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন, আবার সার্কেলেও মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন। ওই সার্কেলের তদন্তে বেরিয়ে আসার পর কয়েকজন বরখাস্ত ও একজনের চাকরি হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শুধু এই দুইজন নয়-অসংখ্য করদাতার সঙ্গে জালিয়াতির মাধ্যমে আনা করের টাকা দিয়ে কাজল মোল্লা মেরে দিয়ে আঙ্গুর ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন। করেছেন একাধিক বাড়ি, রয়েছেন সম্পদ, নগদ টাকা, একাধিক গাড়ি। ইতোমধ্যে এই জালিয়াতের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে আয়কর গোয়েন্দা। তবে, একাধিক কর অঞ্চলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাজল মোল্লা কয়েকটি কর অঞ্চলের এমন বেশ কিছু ফাইল দেখাশোনা করেন। তদন্ত করা হলে এসব ফাইলেও কোটি কোটি টাকার সরকারি টাকা তসরুফের তথ্য বেরিয়ে আসবে।
একাধিক কর কর্মকর্তারা বলেছেন, আয়কর বিভাগের সাবেক দুই সদস্যের প্রশ্রয়ে এই কাজল মোল্লার উত্থান হয়। তাদের প্রশ্রয়ে সে এসব অপকর্ম করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কাজল মোল্লা নিজেকে একটি সংবাদ মাধ্যমের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে কর কর্মকর্তাদের নানান ভয়ভীতি দেখান এবং হয়রানি করে আসছেন। মূলত অপকর্ম জায়েজ করতে আর কর্মকর্তাদের ভয়ের মধ্যে রাখতে সে উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে আসছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
কাজল মোল্লার জালিয়াতি প্রথম যেভাবে ধরা পড়লো
আয়কর গোয়েন্দা সূত্রমতে, কর অঞ্চল-৩, সার্কেল-৪৮ এর করদাতা আসিফ মইন। সার্কেল কর্মকর্তা এই করদাতার ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করেন। যাচাইয়ে দেখতে পান, এই করদাতার বেতন থেকে প্রায় ৯০ লাখ টাকার উৎসে কর কর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এই ৯০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমার কোনো চালান রিটার্নের সঙ্গে দেয়া হয়নি। তবে একটি টপশীটে ১২টি চালানের নাম্বার লিখে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতিটি চালানে সাড়ে ৭ লাখ টাকা করে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কর কর্মকর্তা ১২টি চালান যাচাই করেন। যাতে দেখতে পান প্রতিটি চালানে সাড়ে ৭ লাখ নয়, মাত্র ৩ লাখ টাকা করে ১২টি চালানে ৩৬ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। অর্থাৎ বাকি ৫৪ লাখ টাকা গায়েব। এখানে শেষ নয়। ওই করদাতার ফাইলে একটি কোম্পানি থেকে ডিভিডেন্ট হিসেবে যে টাকা পেয়েছেন, তার উপর ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা কর কর্তন করা হয়েছে বলে ফাইলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই করের টাকা যে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে, তার কোনো চালান নেই। টাকা জমা দেওয়ার প্রত্যয়নপত্র হিসেবে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পে-অর্ডারের একটি ফটোকপি দেওয়া হয়েছে। তবে সেই পে-অর্ডারে জমা ও প্রাপ্য ট্যাক্সের সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই করদাতার নামে কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। একের অধিক গাড়ি থাকলে পরিবেশ সারচার্জ দিতে হয়। ওই গাড়ির উপর সাড়ে ৭ লাখ টাকা ট্যাক্স দেওয়া হয়নি। এই করদাতার বেতন খাত, ডিভিডেন্ট-এই দুই খাতে প্রায় তিন কোটি টাকার কর করদাতা থেকে নেয়া হলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। এছাড়া গাড়ির সারচার্জ দেওয়া হয়নি। কর্মকর্তা করফাইলে অসঙ্গতি পাওয়ার পর খবর চলে যায় সেই কাজল মোল্লার কাছে। কাজল মোল্লা এক আইনজীবী নিয়ে হাজির হন। মোল্লা চালান জালিয়াতির বিষয় অস্বীকার করেন। চালান জমা দেবেন বলে জানান। সার্কেল থেকে করদাতা আসিফ মইনকে ডাকা হয়। তিনি ভুলে পরিবেশ সারচার্জ দেওয়া হয়নি বলে স্বীকার করেন। তবে বেতন ও ডিভিডেন্ট খাতের সব করের টাকা তিনি কাজল মোল্লাকে দিয়ে দিয়েছেন বলে জানান। কাজল মোল্লার জালিয়াতি দেখে এই করদাতাও হতভম্ব হন। তিনি প্রতি করবর্ষে কাজল মোল্লাকে কর হিসেবে বিপুল টাকা দিয়েছেন বলে সার্কেলকে জানান। এভাবে কাজল মোল্লার জালিয়াতি প্রথমবার সামনে আসে। জালিয়াতি সামনে আসার পর থেকে নিজে বাঁচতে কাজল মোল্লা সার্কেল কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি শুরু করেন।
তিন করদাতা থেকে কর হিসেবে নিয়ে আত্মাসৎ করেছেন প্রায় ২০ কোটি টাকা
আয়কর গোয়েন্দা সূত্রমতে, কর অঞ্চল-৩, সার্কেল-৪৮ এর করদাতা আসিফ মইন, মাহমুদ বিন কাশেম ও সৈয়দ মাজহারুল হক। এর মধ্যে আসিফ মইন ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর মুহাম্মাদ বিন কাসেম ও সৈয়দ মাজহারুল হক পরিচালক। তিনজনই নিয়মিত রিটার্ন দাখিল ও কর প্রদান করে আসছে। কর কর্মচারী পরিচয়ে তিনজনের রিটার্ন ও কর জমা দিয়ে সহযোগিতা করার ফন্দি আঁটেন কাজল মোল্লা। কাজল মোল্লা প্রতিবছর এই তিন করদাতা থেকে করের কথা বলে মোটা অংকের টাকা নিয়ে আসতেন। নিয়ম করে রিটার্ন ও কর জমা দিয়ে কাগজপত্র তাদের দিয়ে আসতেন। কর আইনজীবী না হয়েও সার্কেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘ম্যানেজ’ করে মামলা পরিচালনা করতেন। রিটার্নের সঙ্গে প্রতিবছর কর জমার যে চালান দিতেন, তা ছিলো জাল। প্রতিবছর এই তিন করদাতা থেকে করের কথা বলে অন্তত ২-৩ কোটি টাকা নিয়ে আসতেন। কিন্তু কোষাগারে জমা দিতেন নামমাত্র টাকা। তার মধ্যে বেশিরভাগ জাল চালান দিতেন।
আয়কর গোয়েন্দার যাচাইয়ে দেখা গেছে, আসিফ মইনের ২০১২-১৩ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত ১৩ বছরের আয়কর রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে। যাতে দেখা গেছে, প্রায় ১৮ কোটি টাকা করফাঁকি হয়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগ টাকা ‘চালানে’ জমা দিয়েছেন মোল্লা। কিন্তু সেই চালানগুলো ছিলো জাল। আসিফ মইন আয়কর গোয়েন্দাকে জানিয়েছেন, তিনি প্রতিবছর কাজল মোল্লার দাবি করা করের সমপরিমাণ টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আবার মাহমুদ বিন কাশেমের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে। যাতে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা করফাঁকি বের হয়েছে। এই করদাতার ফাইলেও কর জমার যেসব চালান রয়েছে, তার বেশিরভাগ জালা। এই করদাতাও আয়কর গোয়েন্দাকে জানিয়েছেন, তিনি কাজল মোল্লাকে করের টাকা দিয়েছেন। আর করদাতা সৈয়দ মাজহারুল হকের ২০১৬-১৭ থকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন যাচাই করা হয়। যাতে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা করফাঁকি হয়েছে। তবে এই করফাইলের সঙ্গেও কর হিসেবে জমা দেওয়া চালান ছিলো জাল।
আয়কর গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছেন, ফারইস্ট নিটিংয়ের এই তিন কর্মকর্তার করফাইলে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকা ফাঁকি বের হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা করফাঁকি ও জরিমানা প্রায় ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। তবে এই তিন করদাতা কাজল মোল্লার প্রতারণা ও জালিয়াতির শিকার হয়েছেন বলে আয়কর গোয়েন্দার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। তিন করদাতা নিরুপায় হয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ইতোমধ্যে ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন বলে আয়কর গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে। তবে এই তিন করদাতা চলতি বছরের ২৫ মে গুলশান থানায় প্রতারক মো. শাহদাত হোসেন কাজল মোল্লার নামে সাধারণ ডায়েরি করেছেন। যাতে উল্লেখ করা হয়েছে, আয়কর অফিসের নিম্ন কর্মচারী পরিচয় দেওয়া কাজল মোল্লার কথায় বিশ্বাস করে তারা তাদের আয়কর সংক্রান্ত সকল দায়িত্ব প্রদান করেছেন। মোল্লা দীর্ঘদিন যাবত তাদের আয়কর সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা, রিটার্ন জমা ও সকল প্রকার সনদ প্রদান করে আসছে। তবে কর অফিস থেকে তারা জানতে পারেন, তাদের কর বকেয়া রয়েছে। অথচ করের সমপরিমাণ টাকা মোল্লা আমাদের থেকে নগদ নিয়ে গেলেও সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। বিষয়টি সামনে আসার পর কাজল মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। আয়কর গোয়েন্দা কার্যালয়ে কাজল মোল্লাকে কয়েকবার হাজির করতে চিঠি দেওয়া হলেও সে হাজির হয়নি। উল্টো বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এপিএস গ্রুপের দুই কর্মকর্তার ফাইল সার্কেল থেকে নিয়ে সম্পদ বৃদ্ধি করে জালিয়াতি করেছেন
আয়কর গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, করদাতা মো. শামীম রেজা, ইনা রেজা, কনা রেজা, সাবরিনা রেজা ও সামরিনা রেজা। এর মধ্যে মো. শামীম রেজা এপিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একই গ্রুপের এই পাঁচ করদাতাও মো. শাহাদাত হোসেন কাজল মোল্লার প্রতারণার শিকার হয়েছে। বিশেষ করে মো. শামীম রেজা ও ইনা রেজার আয়কর নথি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করেছেন কাজল মোল্লা। তাকে সহায়তা করেছেন কর অঞ্চলের কর্মকর্তারা। আয়কর গোয়েন্দার অনুসন্ধান ও কর অঞ্চল-১, ঢাকার এক অভিযোগ বিবরণীতে বলা হয়েছে, মো. শামীম রেজা ও ইনা রেজা কর অঞ্চল-১, ঢাকার নিয়মিত করদাতা। এর মধ্যে মো. শামীম রেজা কর সার্কেল-৯ (কোম্পানিজ) ও ইনা রেজা সার্কেল-১ (কোম্পানিজ) এর করদাতা। এর মধ্যে মো. শামীম রেজার ২০০৪-০৫ ও ইনা রেজার ২০০৭-০৮ করবর্ষ হতে নথি চালু হয় (প্রথম রিটার্ন দেন)। এই দুই করদাতার ফাইলে প্রথম অবস্থায় সম্পদের পরিমাণ কম দেখানো হয়েছে। সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে কাজল মোল্লা সার্কেল কর্মচারীদের সহায়তায় জালিয়াতির আশ্রয় নেন। এর মধ্যে মো. শামীম রেজা ও ইনা রেজার ২০২১-২২ এর পূর্ববর্তী করবর্ষসমূহের (মো. শামীম রেজার ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ করবর্ষ এবং ইনা রেজার ২০১৩-১৪ হতে ২০১৮-১৯ করর্ষ) রিটার্নসমূহ সার্কেল থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। মূল আয়কর ফাইল নষ্ট করে রিটার্নের তথ্য পরিবর্তন করে ইচ্ছেমতো তথ্য সংযোজন করে নতুন রিটার্ন তৈরি ও সই জাল করা হয়। সবচেয়ে বেশি যে জালিয়াতি কর আইটি ১০বি বা সম্পদ বিবরণীতে। এই দুইটি ফাইলে অন্তত ৩০ কোটি টাকার সম্পদ বাড়িয়ে দেখানো হয়। যার মধ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা করে নগদ অর্থ সংযোজন করা হয়। আয়কর গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মো. শামীম রেজা, ইনা রেজা, সাবরিনা রেজা ও সামরিনা রেজা-এই চারটি ফাইলে জালিয়াতি করে কাজল মোল্লা প্রায় ৪০ কোটি টাকার ভুয়া ক্যাপিটাল ও সম্পদ দেখিয়েছেন। যাতে করফাঁকি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। অ্যাসেসমেন্ট শেষে চারটি ফাইল বর্তমানে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে রয়েছে।
শামীম রেজা ও ইনা রেজার ঘটনা যেভাবে জানাজানি হয়
সূত্রমতে, মো. শামীম রেজা ২০২১ সালে ‘রাষ্ট্রপতি শিল্প উন্নয়ন পুরস্কারের’ জন্য নির্বাচিত হন। এনবিআর থেকে ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শামীম রেজার আয়কর ফাইল কর অঞ্চল থেকে চাওয়া হয়। প্রতিবেদন দিতে কর অঞ্চল থেকে সার্কেলের কাছে আয়কর নথি চায় সার্কেল কর্মকর্তা ও উপকর কমিশনার মো. মাজহারুল হক ভূঁইয়া। সার্কেলের প্রধান সহকারী আংকুরের নেছা প্রায় এক সপ্তাহ খুঁজেও নথিটি সার্কেলে পায়নি। সঙ্গে মো. শামীম রেজার স্ত্রী ইনা রেজার ফাইলও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এই দম্পত্তির সন্তান সাবরিনা রেজা ও সামরিনা রেজার ফাইল পাওয়া গেছে। অথচ এই চারটি ফাইল জমা দিতেন কাজল মোল্লা। কাজল মোল্লাকে সার্কেলে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ফাইল সরানোর বিষয় অস্বীকার করেন। সার্কেল কর্মকর্তা জানতে পারেন, শামীম রেজা ও ইনা রেজার ফাইল সার্কেল থেকে সরিয়ে বাইরে আগের সব নথি নষ্ট করে নতুন ফাইল করছেন কর অঞ্চল-২, ঢাকার কর পরিদর্শক আব্দুল বারী। এছাড়া সার্কেল থেকে নথি সরানোর সঙ্গে কারা জড়িত-সব জেনে যান সার্কেল কর্মকর্তা। তবে কাজল মোল্লার পরিকল্পনা ও অর্থায়নে ফাইল সরানো হয়েছে বলে জানতে পারেন সার্কেল কর্মকর্তা।
কর অঞ্চলের তদন্ত কমিটি, কোন কোন কর্মচারী জড়িত, কিভাবে ফাইল সার্কেলের বাইরো গেলো
তদন্তে দেখা গেছে, কাজল মোল্লা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই কাজে হাত দেন। জালিয়াতিতে অংশ নেন কর অঞ্চল-২, ঢাকার কর পরিদর্শক মো. আব্দুল বারী, কর অঞ্চল-১, ঢাকার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সো. সেলিম শরীফ, নিরাপত্তা প্রহরী মো. নজরুল ইসলাম, কর অঞ্চল-১৪, ঢাকার নোটিশ সার্ভার সৈয়দ শাকিল হোসেন। কাজল প্রথমে কর অঞ্চল-১৪, ঢাকার নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেন ও কর অঞ্চল-১, সার্কেল-২১ এর নিরাপত্তা প্রহরী মো. নজরুল ইসলামকে শামীম রেজা ও ইনা রেজার দুইটি আয়কর নথির রেকর্ড পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন। এতে তারা রাজি হন। নিরাপত্তা প্রহরী মো. নজরুল ইসলাম নথি দুইটি সার্কেল থেকে সরাতে সার্কেল-৯ এর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সেলিমকে ৩ লাখ টাকা দেন। সেলিম শরীফ নথি দুইটি বড় খামে করে নোটিশ সার্ভার গোলাম রাব্বানীর মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেনের কাছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে পৌঁছে দেন। শাকিল হোসেন, আব্দুল বারী ও কাজল মোল্লা-এই তিনজন মিলে এই দুইজন করদাতার নথির রেকর্ড পরিবর্তন করে ২০২২ সালের ১৪ মার্চ সার্কেলে ফেরত দেন। তবে দুই করদাতার আয়কর নথির আদেশ, আইটি-১০বি’র তথ্য পরিবর্তন করা হয়। একইসঙ্গে মূল রেকর্ড নষ্ট কর্মকর্তার সই জাল করা হয়। রেকর্ড জালিয়াতির সময় আব্দুল বারী কাজল মোল্লার সঙ্গে মোবাইল ৩০৪ কথা বলেছেন বলে তথ্য পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তারা। অভিযুক্তদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই জালিয়াতির জন্য কাজল মোল্লা থেকে কর পরিদর্শক মো. আব্দুল বারী ৬০ লাখ টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেনকে ১৬ লাখ টাকা দেন। বাকি ৪৪ লাখ টাকা মেরে দেন। শাকিল এই ১৬ লাখ টাকা থেকে নিরাপত্তা প্রহরী নজরুল ইসলামকে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন। নজরুল ৩ লাখ টাকা সেলিম শরীফকে প্রদান করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে কর পরিদর্শক মো. আব্দুল বারীকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। বাকিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছেন।
কর পরিদর্শক মো. আব্দুল বারী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বিজনেস বার্তাকে বলেন, মানুষের শোনা কথায় আমাকে দুই বছর আগে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। কাজল মোল্লার সঙ্গে ৩০৪ বার কল রেকর্ডের বিষয়ও অস্বীকার করেন। বলেন, মানুষ এতবার কথা বলে? কাজল মোল্লার সঙ্গে সম্পর্ক, নথি সরানো, নগদ টাকা ও সম্পদ সংযোজনের বিষয় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রশ্ন করা হলে লাইন কেটে দেন তিনি।
চালান জালিয়াতি ও করের টাকা মেরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়
আয়কর গোয়েন্দার অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজল মোল্লা কেবল রাজস্ব জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। জালিয়াতিতে সহযোগিতা করেছেন একাধিক কর কর্মচারী। ধূর্ত কাজল মোল্লার আয়কর ফাইলে মোট সম্পদ দেখানো হয়েছে ৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। লাইবিলিটি ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। নীট সম্পদ দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। রাজধানীর মেরাদিয়ায় রয়েছে ৩ কাঠা ১১ ছটাক জমি। মেরাদিয়ায় ৮ কাঠা জমির উপর রয়েছে ৪ ইউনিটের ৯ তলার একটি বাড়ি রয়েছে। খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকায় ১৩০০ স্কয়ারের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। শান্তিনগর কনকর্ড গ্র্যান্ডে ৩৫৩ বর্গফুটের একটি কর্মাশিয়াল স্পেস রয়েছে। খিলগাঁও গোরান এলাকায় ৩ দশমিক ১৬ কাঠা জমির উপর ৬ তলার একটি বাড়ি রয়েছে। নিজ জেলা ঝালকাঠিতে একটি ৬ তলা বাড়ির কাজ চলমান রয়েছে। খিলগাঁও এলাকায় একটি ফ্ল্যাটের অর্ধেক মালিকানা রয়েছে মোল্লার। দুইটি গাড়ি রয়েছে, যার একটির মূল্য দেখা হয়েছে ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, অপরটির দাম ১৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। ঢাকায় এস এম ইলেকট্রনিক নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখানো হলেও তার কোন অস্তিত্ব নেই। রয়েছে দুইজন স্ত্রী। কাজল মোল্লার করফাইলে দেখানো সম্পদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সম্পদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তবে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। প্রাথমিক যাচাইয়ে জালিয়াতি করে রাজস্বের টাকা মেরে কোটি কোটি টাকার পকেটে ভরেছে বলে মনে করেন কর কর্মকর্তারা। কাজল মোল্লার ফাঁকির অনুসন্ধানে ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ওয়ান ব্যাংক ও ডাচবাংলা ব্যাংকে কাজল মোল্লার নামে ৩০টি হিসাব পাওয়া গেছে, যাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন কর্মকর্তারা। হিসাব জব্দ করার পর কাজল মোল্লা উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। তবে আদালত কোন নির্দেশনা দেয়নি।
কর নথি সরিয়ে নগদ টাকা ও সম্পদ সংযোজন করা, চালান জালিয়াতি ও করের টাকা মেরে দেয়ার বিষয়ে জানতে বিজনেস বার্তার পক্ষ থেকে মো. শাহাদাত হোসেন কাজল মোল্লার ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ, পরে ফোন দেন।’ অন্য প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর ফোন দেয়া হলে আর রিসিভ করেননি।
কাজল মোল্লার চালান জালিয়াতি, করফাঁকিতে সহায়তা, করের টাকা মেরে দেওয়ার বিষয়টি আয়কর গোয়েন্দার প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বলে স্বীকার করেন আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের মহাপরিচালক মো. আবদুর রকিব। তিনি বিজনেস বার্তাকে বলেন, করফাঁকির বিরুদ্ধে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়ছি। করফাঁকিতে যে বা যারা জড়িত থাকুক না কেন-কোন ছাড় দেয়া হবে না। এমনকি করফাঁকি, কর জালিয়াতিতে আয়কর বিভাগের কেউ জড়িত থাকলেও ছাড় দেওয়া হবে না।
** ৮০ হাজার টাকা বেতনের এসিটি থাকেন ১২ কোটি টাকার ফ্ল্যাটে
** উপ-কর কমিশনার মেহেদীর ছয় কোটি টাকার সম্পদ!
** অবৈধ সম্পদ: অতিরিক্ত কর কমিশনার মারুফ বরখাস্ত