** বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিমাসে গড়ে বিক্রি কম দেখিয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা
** প্রতিমাসে গড়ে ৪৪ লাখ টাকা করে ভ্যাট ফাঁকি, ভ্যাট ফাঁকি দিতে কাগজপত্র লুকিয়ে ফেলা হতো
** ভ্যাট ফাঁকি থেকে বাঁচতে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ করে ব্যবসায়ীদের ক্ষেপিয়ে তোলেন
১২ মাস বা এক বছরে প্রায় ৪৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। কিন্তু দাখিলপত্রে (ভ্যাট রিটার্ন) মাত্র ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা বিক্রি দেখিয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে বিক্রি কম দেখিয়েছে ৪০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। প্রতিমাসে গড়ে বিক্রি কম দেখিয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। গোপন করার বিক্রয়মূল্যের উপর ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিমাসে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা। বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই বিপুল পরিমাণ বিক্রি গোপন ও ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে যশোর ভ্যাট কমিশনারেট। চুয়াডাঙ্গার দৌলতদিয়াড় আলোকদিয়া এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি মাত্র এক বছরে এত বিপুল পরিমাণ বিক্রি গোপন ও ভ্যাট ফাঁকিতে হতবাক ভ্যাট কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ফাঁকি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি গোপন ও ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। একইসঙ্গে বিক্রি গোপন ও ভ্যাট ফাঁকি থেকে বাঁচতে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রথমবার ভ্যাট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ করেন। পরে কৌশলে ব্যবসায়ীদের ক্ষেপিয়ে তুলে ভ্যাট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা।
এনবিআর সূত্রমতে, বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বিক্রি গোপন করে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে আসছে এমন গোপন সংবাদ পায় যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। এই প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনে কমিশনারেট থেকে অতিরিক্ত কমিশনার রাকিবুল হাসানের নেতৃত্বে একটি প্রিভেন্টিভ টিম গঠন করা হয়। ওই টিম ৬ জানুয়ারি ১২টা ৪০ মিনিটে চুয়াডাঙ্গার আলোকদিয়ায় অবস্থিত মেসার্স বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজের ফ্যাক্টরিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হাফিজুর রহমান টিমকে স্বাগত জানায়। টিমে থাকা ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের নিকট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন, বিক্রি ও ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি দেখতে চান। প্রতিষ্ঠান দলিলাদি দিলে তাতে প্রাথমিকভাবে কিছু অসঙ্গতি ও ভ্যাট ফাঁকির আলামত পাওয়া যায়। পরে ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. তরিকুল ইসলাম পিনু নামে একজনের কম্পিউটার থেকে পৃথক তিনটি বিক্রয় তথ্য পান। একটা ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যিন্ত, আরেকটি ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যলন্ত, অপরটি ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যরন্ত। এর মধ্যে ‘লাস্ট ওয়ান ইয়ার সেলস রিপোর্ট অব বঙ্গ পিভিসি’-শিরোনামে ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্য।ন্ত রিপোর্টটি সঠিক বলে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হাফিজুর রহমান ও অন্যান্য কর্মকর্তারা ভ্যাট কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করেন। পরে হাফিজুর রহমান সেই রিপোর্টটিতে সই করেন। এছাড়া, অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করেন।
সূত্র আরো জানায়, একই সময়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদের সাথে কথা বলে ভ্যাট কর্মকর্তারা জানতে পারেন, সিপিআই ট্রেডিং নামীয় প্রতিষ্ঠানটি তারই। ভ্যাট কর্মকর্তাদের ধারণা, অপর একটি প্রতিষ্ঠান ডিপ স্যানিটারি ও একই মালিকের বা তারই আত্নীয়-স্বজন অন্য কারো হতে পারে। ফলে প্রকৃত ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনের জন্য প্রিভেন্টিভ টিমের কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের সেলস রিপোর্ট, বিদ্যুৎ বিল, একাউন্ট রিসিভেবল শীট, রেজিস্টার খাতা, ফিজিক্যাল স্টক, মূসক ৬.৩ এবং কম্পিউটার সিপিইউ প্রভৃতি জব্দ করে নিয়ে আসেন।
জব্দ করা কাগজপত্র ও দলিলাদি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যপন্ত (১২ মাসে) দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) মোট বিক্রয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৯০ লাখ ১৭ হাজার ৮৭৪ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাইয়ে দেখা গেছে, এই ১২ মাসে প্রতিষ্ঠানটির মোট পণ্য বিক্রি করেছে ৪৩ কোটি ৩৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৮৩ টাকা। অর্থাৎ ১২ মাসে বিক্রি কম দেখিয়েছে ৪০ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার ১০৯ টাকা। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে বিক্রি কম দেখিয়েছে ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তবে গোপন করা এই বিক্রির মধ্যে ভ্যাট বা মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি করেছে ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার ৫৩০ টাকা। যার উপর ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট বা মূসক ৫ কোটি ২৮ লাখ ১৯ হাজার ৫৭৯ টাকা। যা প্রতিষ্ঠানটি ফাঁকি দিয়েছে। অর্থাৎ ১২ মাসে এই ফাঁকি হলে প্রতিমাসে গড়ে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য এই ভ্যাট ফাঁকি বিশাল বলে মনে করেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে ৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। একইসঙ্গে ১২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়।
যশোর ভ্যাট কমিশনারেট সূত্রমতে, বিক্রয় গোপন ও ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনের বিষয়টি টের পেয়ে যান প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এরপরই বিক্রয় গোপন ও ভ্যাট ফাঁকি থেকে বাঁচতে কূটকৌশল শুরু করেন। প্রথমে প্রিভেন্টিভ টিমের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ‘লাঞ্চিত’ ও ঘুষ দাবির অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। কৌশলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ভ্যাট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করানো হয়। পরে ব্যবসায়ীদের ব্যানারে আবার মানববন্ধন করা হয়। সেখানে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
তবে চুয়াডাঙ্গা জেলার একাধিক ব্যবসায়ী ও ভ্যাট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মালিক প্রতিষ্ঠানটি প্রায়ই বন্ধ ঘোষণা করেন। তবে যশোর ভ্যাট কমিশনারেটের কাছে গোপন সংবাদ ছিলো যে, মালিক কৌশল করে প্রতিষ্ঠানটি রাতে চালু রাখেন। এবং ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে রাতেই বিভিন্ন যানবাহন (ভ্যান, ছোট পিকাপ ইত্যাদি) এর মাধ্যমে মূসক চালান ছাড়াই উৎপাদিত পণ্য শহরে অবস্থিত অন্য কোনো গোপনীয় গুদামে তা সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতে ওই গুদাম হতে পণ্য সরবরাহ করেন। সর্বশেষ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে এই ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। ভ্যাট কর্মকর্তারা মালিক পক্ষের কারো সঙ্গে কোন ধরনের ঘুষ দাবি ও অসদাচরণ করেনি। প্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমন কি গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনদিন এই প্রতিষ্ঠানে প্রিভেন্টিভ পরিচালনা করা হয়নি। কারণ কর্মকর্তারা যাওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠান কাগজপত্র সরিয়ে ফেলেন। আর গোপন গুদামে পণ্য সংরক্ষণ করে রাখেন।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদ এর নাম্বারে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াইটসঅ্যাপে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে দেওয়া হলে তিনি সিন করেন। কিন্তু কোন জবাব দেননি।