অলিগলিতে সারি সারি হোটেল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে রেস্তোরাঁ, ভবনের ছাদে ঝকঝকে রুফটপ রেস্টুরেন্ট। দূরপাল্লার সড়কে যাত্রী বিরতির জন্য মোটেলও আছে। রাতের ঢাকায় আলো ছড়িয়ে জ্বলজ্বল করে এসব হোটেল-রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড। ভেতরে চা-কফি থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি নানা খাবারের সমারোহ। চাহিদা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে দামও। তবু ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে গেলে জায়গা পাওয়া কঠিন—ওয়েটিং লিস্টে নাম তুলতেই হয়। ভ্যাটের অজুহাতে গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করা হয়, কিন্তু সেই টাকা সরকারি কোষাগারে পৌঁছায় না। বরং ভাগ হয়ে যায় হোটেল মালিক ও রাজস্বকর্মীদের পকেটে। এক অর্থবছরে এভাবে অন্তত ১৮ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়। অথচ সরকার পায় মাত্র সোয়া ৫০০ কোটি টাকা। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই খাতের ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকিতে জড়িত।
২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) নিবন্ধিত হোটেল ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৪৩। এর মধ্যে হোটেল রয়েছে ৩ হাজার ১১৫টি এবং রেস্তোরাঁ ১০ হাজার ৬২৮টি। কিন্তু বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির তথ্য বলছে, দেশে হোটেল-রেস্তোরাঁর সংখ্যা চার লাখ ৮২ হাজার। সে হিসাবে মাত্র ২.৮৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দিচ্ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২১ সালের জরিপে দেশে হোটেল-রেস্তোরাঁর সংখ্যা ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪। এই হিসাবে ভ্যাট প্রদান করছে মাত্র ৩.১৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া অনলাইন খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডার সঙ্গে যুক্ত আছে ৮০ হাজারেরও বেশি হোটেল-রেস্তোরাঁ, যা দেশের মোট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৭.১৭ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হোটেল-রেস্তোরাঁ খাত থেকে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৫২৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে এ খাতে আদায় হয়েছিল ৫৪৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ফলে সর্বশেষ অর্থবছরে আদায় কমেছে ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হোটেল খাত থেকে ভ্যাট আদায় হয়েছিল ২৪৬ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ১৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২১০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে, রেস্তোরাঁ খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৩০২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা পরের বছরে ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৬ কোটি ৮০ হাজার টাকা।
হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে বর্তমানে ভ্যাটহার ৫ শতাংশ। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি অধ্যাদেশ জারি করে এ হার ১৫ শতাংশ করা হলেও পরে আবার তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ৫ শতাংশ হারে সর্বশেষ অর্থবছরে সরকার ভ্যাট পেয়েছে ৫২৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সে হিসাবে ওই সময়ে মানুষ হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৫৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার খাবার।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা গেলে সরকার বছরে গড়ে অন্তত ১৬ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট পেতে পারত। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাবে এ খাত থেকে ভ্যাট পাওয়ার কথা ১৮ হাজার ৪৬০ কোটি ৬০ লাখ টাকা, আর বিবিএসের হিসাবে ১৬ হাজার ৭০৯ কোটি ২৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা। এমনকি ফুডপান্ডায় নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তিতেও ভ্যাট পাওয়ার সম্ভাবনা দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অথচ বাস্তবে সরকার এই সম্ভাবনাময় খাত থেকে পাচ্ছে মাত্র ৫২৬ কোটি টাকা, ফলে বছরে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ‘এখন দেশে চার লাখ ৮২ হাজার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে। এর মধ্যে অল্পসংখ্যক সরকারের ভ্যাট পরিশোধ করে। বাকিরা এই ভ্যাটের টাকা পকেটে ঢুকায়। এসব হলো ভ্যাট কর্মকর্তাদের চুরি করার একটা রাস্তা। সবাইকে তাঁরা ভ্যাটের আওতায় আনতে চান না। ফলে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের টিকে থাকা কঠিন। যারা ভ্যাট দেয় তাদের ওপরই জুলুম হয়, যারা দেয় না তাদের কোনো সমস্যা নেই। সেখান থেকেই চাঁদা নিয়ে তাঁরা (কর্মকর্তারা) চলেন।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামীম আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে ভোট ও জনপ্রিয়তার একটা বিষয় থাকে। তাই অনেক জায়গায় ভ্যাটের কর্মকর্তারা গিয়েও ভ্যাট আদায় করতে পারতেন না। গেলেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন আসত। এখন একটা সুযোগ ছিল অন্তত নিবন্ধনের আওতায় আনার। যেহেতু ভ্যাট ব্যবসায়ী পরিশোধ করেন না, করেন গ্রাহক। সরকারকে অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলোকেও নিবন্ধিত করতে হবে।’
** পাঁচ মহাসড়কে ৭০ রেস্টুরেন্ট, ভ্যাট ফাঁকি বন্ধ হচ্ছে
** মহাসড়কে হোটেল-রেস্তোরাঁয় ইএফডি বাধ্যতামূলক
** জেনেক্সের জালিয়াতি: ইএফডি মেশিন বসাতে ‘ঘাপলা’
** ২৩১০টি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেয় না
** জালিয়াতি করায় বাদ পড়ছে জেনেক্স!
** জেনেক্স মালিক ইউসিবি থেকে সরিয়েছেন ২ হাজার কোটি

