** ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৩ সালে হজের কোটা পূর্ণ হয়নি, ২০২৪ সালে মাত্র ৮৫,২৫৭ জন হজে গেছেন
** বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫ সালের হজের ব্যয় কমাতে আগ্রহী, মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে
** হজে গমনকালে প্রত্যেক হজযাত্রীকে ২ হাজার টাকা এক্সাইজ ডিউটি ও ৪৩২ টাকা ভ্যাট দিতে হয়
হজ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি। হজের মতো একটি পবিত্র কাজেও থাকে সিন্ডিকেটের যোগসাজশ। এ সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে হজযাত্রীদের অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দুই বছর বাংলাদেশে হজের কোটা পূর্ণ হয়নি। ২০২৫ সালে হজের ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের এ মহতী উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বিমান ভাড়া কমাতে ইতিবাচক উদ্যোগ নিচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। তবে হজের ব্যয়ের মধ্যে একটি অংশ হলো কর। প্রতি হজযাত্রীকে এক্সাইজ ডিউটি ও ভ্যাট হিসেবে ২ হাজার ৪৩২ টাকা দিতে হয়। সরকারের ব্যয় কমানোর ইতিবাচক উদ্যোগের সঙ্গে এই কর মওকুফের মতো মহতী উদ্যোগ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সে জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানকে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এই চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠি পেয়ে কাজ শুরু করেছে এনবিআর।
ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রফিকুল ইসলাম সই করা চিঠিতে হজযাত্রীদের হজে গমনকালে বিমানবন্দরে প্রদেয় কর মওকুফ করার অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে, হজ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হজযাত্রী প্রেরণকারী দেশ। প্রতি বছর সৌদি আরব বাংলাদেশকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের হজে যাওয়ার কোটা বরাদ্দ করে থাকে। এ দেশের মানুষের হজে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে হজের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৩ সালের হজের কোটা পূর্ণ হয়নি। ২০২৪ সালের হজে সরকারি ও বেসরকারি উভয় মাধ্যমে মাত্র ৮৫ হাজার ২৫৭ জন হজে গমন করেছেন। এতে ৪১ হাজার ৯৪১ হজযাত্রীকে কোটা সমর্পণ করতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হজের ব্যয় কমাতে আগ্রহী। সাধারণ মানুষও হজের ব্যয় কমানোর জোর দাবি তুলেছেন। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের হজের ব্যয় কমানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এই বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
আরও বলা হয়েছে, হজযাত্রীরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে হজে গমন করে থাকেন। হজে গমনকালে প্রত্যেক হজযাত্রীকে এক্সাইজ ডিউটি বাবদ ২ হাজার টাকা এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট (সব ধরনের ব্যয়ের ওপর) বাবদ ৪৩২ টাকাসহ মোট ২ হাজার ৪৩২ টাকা কর দিতে হয়। পূর্ণ কোটায় হজযাত্রী প্রেরণ এবং বর্তমান সরকারের হজের বায় হ্রাসের মহতী উদ্যোগকে সফল করার জন্য এই কর মওকুফ করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সরকারের হজের ব্যয় হ্রাসের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের স্বার্থে হজযাত্রীদের বিমানবন্দরে প্রদেয় ২ হাজার ৪৩২ টাকা মওকুফের অনুরোধ করা হলো।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মুসলমানদের অন্যতম স্তম্ভ হজের ব্যয় কমাতে সরকারের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। হজযাত্রী এক্সাইজ ডিউটি ও ভ্যাট কমাতে এনবিআরকে যে চিঠি দেয়া হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। অবশ্যই এনবিআর উদ্যোগ নেবে।
অপরদিকে, ২৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের হজ একটা বড় ব্যাপার মুসলমানদের জন্য। কিন্তু হজের মতো পবিত্র কাজেও একটি সিন্ডিকেট দেখতে পাই। তারা কারসাজি করে হজের প্যাকেজ মূল্য বাড়িয়ে তোলে। হজের যে খরচ, সেটি যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা যায়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। কত হতে পারে, কত কমানো যেতে পারে সেই আলোচনা হয়। বর্তমান প্যাকেজ যে অনেক বেশি, সেটি কমিয়ে আনা সম্ভব, সে বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের হজের খরচের হিসাব অনুযায়ী, একজন হজযাত্রীকে যে ব্যয় ভ্রমণ করতে হয় তাহলো—বিমান ভাড়া ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা; মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া ২০৪৪৪৪.৯১ টাকা; জেদ্দা, মক্কা, মদিনা-মুযদালিফা, আল-মাশায়েরের পরিবহন ব্যয় ৩৫ হাজার ১৬২.৪৩ টাকা; বাস সার্ভিস ২ হাজার ৮৩৯ টাকা; জমজম পানি ৪২৫.৮৫ টাকা; তাঁবু, ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ-কম্বল, খাবার সরবরাহে মোয়াল্লেম সেবার সার্ভিস চার্জ ১৬০৬৩০.৬২ টাকা; মক্কায় লাগেজ পরিবহন ৫৮৭.৬৭ টাকা; মক্কা-মদিনা-আরাফাত-মুজদালিফা-মিনা-মক্কা বাস ভাড়া ১৯৩৩৩.৫৯ টাকা; দেশে ফেরার সময় মক্কা-মদিনা থেকে লাগেজ পরিবহন ৮৫১.৬৭ টাকা; ভিসা ফি ৮ হাজার ৫১৭ টাকা; স্বাস্থ্য বীমা বাবদ সৌদি সরকারকে দেয়া ফি ৯৪৬.৮১ টাকা; আইটি কার্ড, লাগেজ ট্যাগিং, আইটি সার্ভিস ইত্যাদি ৮০০ টাকা; হজযাত্রীদের কল্যাণ তহবিল ২০০ টাকা; প্রশিক্ষণ ফি ৩০০ টাকা; খাওয়া খরচ ৩৫ হাজার টাকা; হজ গাইড ১৫১৭৮.১০ টাকা।
আগামী বছরের হজের প্রাথমিক নিবন্ধনের সময়সীমা ৩০ নভেম্বর। গত ২৫ আগস্ট ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, আগামী বছরের হজের জন্য ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। পরে ওই সময়সীমা কমিয়ে ২৩ অক্টোবর ঠিক করার কথা জানিয়েছিল মন্ত্রণালয়। বর্তমানে হজে যেতে হলে প্রথম ধাপে ৩০ হাজার টাকা ফি পরিশোধ করে প্রাক নিবন্ধন করতে হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে সারতে হয় প্রাথমিক নিবন্ধন। আর হজের প্যাকেজ ঘোষণা হলে বাকি টাকা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করা যায়। ২০২৫ সালের হজের প্যাকেজ আগামী ৩০ অক্টোবর ঘোষণা করা হবে ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ পোর্টালের তথ্যানুযায়ী সূত্রমতে, ২০২৪ সালের সরকারি হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা এবং বেসরকারি হজ প্যাকেজ খরচ ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা। খরচ বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর হজ কোটার প্রায় ৩৫ শতাংশ পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। এবার ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের কোটা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী ছিল ৮৫ হাজার ২৫৭ জন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের জন্যও একই সংখ্যক কোটা পেয়েছে বাংলাদেশ। এবার যাতে কোটা পূরণ হয়, সে জন্য খরচ কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন হজযাত্রী ও এজেন্সিরা।