Header – Before
Header – After

স্ট্রোকের চিকিৎসায় নতুন আশা ‘মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি’

মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলের পথে জমাট বাঁধা রক্তই অনেক সময় প্রাণঘাতী স্ট্রোকের কারণ হয়। একসময় দ্রুত হাসপাতালে না পৌঁছালে স্ট্রোকের চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত। এখন ‘মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি’ প্রযুক্তি সেই অবস্থায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। রোগীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিতে পারলে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নালির ভেতর জমাট রক্ত সরিয়ে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক করা সম্ভব। এতে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।

বিশ্বের উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস) এখন দিচ্ছে এই আধুনিক সেবা। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এ চিকিৎসা পরিচালনা করছেন। টিমের নেতৃত্বে আছেন নিনসের স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজির বিশেষজ্ঞ ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু, যিনি তুরস্ক থেকে এ বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। নতুন করে ক্যাথল্যাব প্রস্তুত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

দৈনিক গড়ে নিনসে স্ট্রোকের প্রায় ৪০০ রোগী এসে থাকেন, তবে তাঁদের মধ্যে মাত্র দুই থেকে তিনজনকে মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি দেওয়া সম্ভব হয়। দেশে প্রতি হাজার জনে গড়ে ১৩ দশমিক ৬ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ২৩ শতাংশ রোগীর বয়স ৫০ বছরের নিচে। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪ সালের এক গবেষণা বলছে, ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সীদের মধ্যে স্ট্রোকের হার সবচেয়ে বেশি—এই বয়সসীমার ২৮ শতাংশ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। প্রতিবছর ২৯ অক্টোবর স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে দিবসটি উদ্‌যাপন করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য— ‘প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ’।

ডা. হুমায়ুন কবীর বলেন, স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রতিটি মিনিটই মূল্যবান। যত দ্রুত বন্ধ রক্তনালি খুলে দেওয়া যায়, তত বেশি কোষ বাঁচানো সম্ভব। মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি মস্তিষ্কের বড় অংশকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে। তিনি আরও বলেন, অনেক মানুষ এখনও জানে না যে স্ট্রোকের চিকিৎসা সম্ভব। আমাদের দেশে অনেকে মনে করেন, স্ট্রোক মানেই পঙ্গুত্ব। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ দ্রুত হাসপাতালে আসে।

স্ট্রোক দুভাবে হতে পারে। মস্তিস্কে রক্তনালি বন্ধ হয়ে এবং ফেটে গিয়ে। ৮০ শতাংশ স্ট্রোকই রক্তনালি বন্ধ হয়ে হয়। প্রথমে সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করে রক্তনালি বন্ধের কারণে, না ফেটে যাওয়ার কারণে স্ট্রোক হয়েছে তা নিশ্চিত হতে হয়। শুধু রক্তনালি বন্ধ হয়ে যার স্ট্রোক হয়, তাকেই মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমির চিকিৎসা দেওয়া হয়। মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি ছোট ধরনের অস্ত্রোপচার, যা করা হয় ক্যাথল্যাবে। হার্ট অ্যাটাকে রক্তনালিতে যেমন স্টেন্ট বসানো হয়, তেমনি এ চিকিৎসায় মস্তিষ্কের বন্ধ রক্তনালি খুলে দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সফলভাবে এই চিকিৎসা করা রোগীদের ৫০ শতাংশ পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান, মৃত্যুহার কমে ৯০ শতাংশে।

স্ট্রোক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আফজাল মমিন বলেন, সরকারি ভর্তুকি, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক তৈরি ও বিভাগীয় পর্যায়ে ক্যাথল্যাব স্থাপনের মাধ্যমে মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি সেবা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। স্ট্রোক বিশ্বে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। সময়মতো আধুনিক চিকিৎসা পেলে স্ট্রোক থেকে মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব রোধ করা যায়। তবে এই রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন সচেতনতা নেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, দেশে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। ২০২২ সালের এক জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, প্রতি হাজার জনে ১১ দশমিক ৩৯ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ময়মনসিংহ বিভাগে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি, রাজশাহীতে সবচেয়ে কম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, মানসিক চাপ, ফাস্টফুড গ্রহণ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোক বাড়াচ্ছে। তরুণদের মধ্যে রাত জাগা ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তিনি আরও বলেন, স্ট্রোকের প্রথম চার ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করলে বেশির ভাগ রোগী পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তবে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিতে স্ট্রোকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে এলে রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, ঢাকা ও এর বাইরে স্ট্রোকের চিকিৎসায় ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য আমরা সারাদেশে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আটটি বিভাগীয় শহরে ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ হচ্ছে। স্ট্রোক চিকিৎসাকেও আমরা এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করছি।

** কম বয়সীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!