Header – Before
Header – After

সোনাদিয়া দ্বীপ: প্রকৃতি-পর্যটনের নতুন ঠিকানা

সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে পর্যটন সম্ভাবনায় ভরপুর সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। কক্সবাজারের মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটি মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা। শীত মৌসুমে অতিথি বালিহাসসহ নানা পাখির আবাসে দ্বীপটি হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত। প্রায় ৪,৯২৮ হেক্টর আয়তনের সোনাদিয়া দ্বীপ পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘাকৃতি, যা অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ।

কক্সবাজারের পর্যটনে নতুন সম্ভাবনার নাম সোনাদিয়া দ্বীপ। শৈল্পিক প্রাকৃতিক গঠন, বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, কাছিম প্রজনন কেন্দ্র, চামচঠোট বাটন পাখি ও অতিথি পাখির অভয়ারণ্য—সব মিলিয়ে দ্বীপটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে। দ্বীপে রয়েছে ৩.১৫ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি, দুটি শুটকি মহাল, ৯৮ একর চিংড়ি চাষের জমি এবং বন বিভাগের ২১০০ একর ভূমি; বাকিটা প্রাকৃতিক বনায়ন ও বালুচর। নির্জন ও দূষণমুক্ত সৈকত, লাল কাকড়ার সমাগম, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম, হযরত মারহা আউলিয়ার মাজার, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, মনোমুগ্ধকর সূর্যাস্ত এবং প্যারাবনঘেরা আঁকাবাঁকা নদীপথে নৌভ্রমণ—সবই সোনাদিয়াকে করে তুলেছে অনন্য।তবে পর্যটনের এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো আধুনিক উদ্যোগ বা পরিকল্পনা না থাকায় দ্বীপটি এখনো পর্যটন বিকাশে পিছিয়ে রয়েছে।

সঠিক পরিকল্পনা পূর্বক তা বাস্থবায়ন করা গেলে পর্যটন রাজধানী হিসাবে পরিচিত কক্সবাজার শহরের অতীব নিকটবর্তী এ দ্বীপটি পর্যটন বিকাশে অন্যতম স্থান হতে পারে। যা দেশের তথা কক্সবাজারের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি দ্বীপবাসীর জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই দ্বীপে দ্বীপবাসীর সম্পৃক্ততায় কমিউনিটি ভিত্তিক ইকোট্যুারিজমের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যা দ্বীপবাসীর বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা সহ অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন উলেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। সোনাদিয়ার দ্বীপের নামকরণের সঠিক কোন ঐতিহাসিক তথ্য না থাকলেও সোনাদিয়ার দ্বীপকে ঘিরে আদিকাল হতে সোনা সমতুল্য দামি পন্য মৎস্য সম্পদ আহরিত হত বলে এই দ্বীপ সোনার দ্বীপ, সোনাদিয়া বলে পরিচিতি। তাই ঐতিহাসিক ভাবে না হলেও লোক মুখে উচ্চারিত সোনাদিয়ার কথা বির্বতনে সোনাদিয়ায় রুপান্তরীত হয়। দ্বীপটি সোনাদিয়া হিসাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছেও বই পুস্তকে স্থান পাচ্ছে। কালক্রমে মানুষ মহেশখালীর অপরাপর এলাকা সমূহে বসবাস শুরু করলেও আদিকাল পরিচিতি সূচনা হয় সোনাদিয়া ঘিরে।

প্রাচীনকালে মানুষের চলাচলের প্রধান মাধ্যম ছিল নদীপথ, আর জীবিকার অন্যতম ভিত্তি ছিল মাছ শিকার। এ কারণে বহু আগ থেকেই মানুষের সঙ্গে সোনাদিয়া দ্বীপের পরিচয় গড়ে ওঠে। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৫৯ সালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর মহেশখালীতে বসতি স্থাপন শুরু হয়; তার আগে মহেশখালী কক্সবাজারের অংশ হিসেবেই পরিচিত ছিল। সময়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম দিক থেকেও অনেক মানুষ এসে এখানে বসতি গড়ে তোলে। বিশেষ করে যারা মাছ শিকারের পেশায় যুক্ত ছিল এবং সোনাদিয়া সম্পর্কে ধারণা রাখত, তারা দ্বীপটিকে স্থায়ী বসবাসের উপযোগী মনে করত।

সোনাদিয়ার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোর মধ্যে ফৌয়জনী পরিবার উল্লেখযোগ্য। ছাদের আলী, আশরাফ মিয়া ও আছাদ আলীর পরিবারকে দ্বীপটির পুরোনো ও ঐতিহাসিক পরিবার হিসেবে ধরা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এই দ্বীপে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন—এমন কথাও স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়। বর্তমানে সোনাদিয়া দ্বীপে প্রায় ৮১০ জন মানুষের বসবাস। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এখানে ভোটার ছিল ৩৮৪ জন। শীত মৌসুমে শুকানো বিভিন্ন প্রজাতির শুটকি মাছের স্বাদ খুবই জনপ্রিয়, তাই কক্সবাজারে আসা অনেক পর্যটকই সোনাদিয়ার শুটকি না নিয়ে ফেরেন না। দ্বীপের শিক্ষা ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়; রয়েছে মাত্র দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দুটি মসজিদ। সাদা বাইন, কালো বাইন, কেওড়া, হরগোজা, নোনিয়াসহ প্রায় ত্রিশ প্রজাতির প্যারাবন উদ্ভিদ এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া মোহনা, চর ও বনভূমিতে পাওয়া যায় ১৯ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির শামুক–ঝিনুক এবং বিভিন্ন প্রজাতির কাকড়া।

যেমন, রাজ কাকড়া, হাব্বা কাকড়া, জাহাজি কাকড়া, সাতারো কাকড়া) সহ প্রায় আশি প্রজাতির সাদা মাছ, ৬৫ প্রজাতির (বিপন্ন প্রায়) স্থানীয় ও যাযাবর পাখি এবং কমপে তিন প্রজাতির ডলফিন বিচরণ করে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছের মধ্যে কোরাল, বোল, বাটা, তাইলা, দাতিনা, কাউন (কনর মাছ) ও প্যারাবন সমৃদ্ধ এলাকার অন্যান্য মাছ পাওয়া যায়। জীববৈচিত্র ও পরিবেশ রায় প্যারাবনের গুরুত্ব অপরিশিম। প্যারাবন ভূমি য়রোধ থেকে এলাকাকে জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড়ের য় তি হতে রা করে।

প্যারাবন সোনাদিয়ার পানির স্বাভাবিক গুণগত মান অক্ষুণ্ন রাখে। এই বন থেকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ঘরবাড়ির বিভিন্ন আসবাব, কাঠ ও জ্বালানি সংগ্রহ করা যায়। প্যারাবন বহু প্রজাতির পাখি ও বন্য প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি সরকারিভাবে পর্যটন সুবিধা গড়ে তোলা হয়, তবে এখান থেকে প্রচুর রাজস্ব আয় সম্ভব। সোনাদিয়া আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে—এমনকি সিঙ্গাপুর বা ইতালির রোম শহরের মতো আধুনিক উন্নয়নও এখানে করা সম্ভব। সরকারের আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনাও কেবল সময়ের অপেক্ষা। সঠিক ব্যবস্থাপনায় সোনাদিয়া হতে পারে সোনার চেয়েও মূল্যবান এক দ্বীপ—ডায়মন্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হতে পারে। এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আসবে, বদলে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তবে এর জন্য প্রয়োজন সবার নীরব সহযোগিতা ও আন্তরিক সহমর্মিতা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!