Header – Before
Header – After

সুদের ফাঁদে আটকে রপ্তানি সহায়তা

রপ্তানি খাতের জন্য গঠিত ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি সহায়ক প্রাক্-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএ) ব্যাংকগুলোর সুদ-স্বার্থ কৌশলের কারণে সমস্যায় পড়েছে। ২০২৩ সালের শুরুতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই তহবিল গঠন করেছিলেন রপ্তানিকারকদের স্বল্প সুদে মূলধন সরবরাহের জন্য, যাতে বৈশ্বিক মন্দা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকটেও উৎপাদন অব্যাহত থাকে। তবে দুই বছর পর তহবিলের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা এখন অচল অবস্থায় রয়েছে, যা ব্যাংকের হিসাবেও নিষ্ক্রিয় অঙ্ক হিসেবে জমে আছে।

রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সংকুচিত হওয়ার পর ইএফপিএকে বিকল্প হিসেবে আশা করা হয়েছিল। তবে ব্যাংকগুলোর আচরণ এই আশা মেলাতে পারছে না। তারা এই সহায়তা প্রকল্পে অংশগ্রহণে প্রায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না এবং নিজের তহবিল থেকে ১৪-১৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে বেশি উৎসাহী। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি সহায়ক বিশেষ তহবিল থেকে ঋণ নেওয়া গেলে সুদ মাত্র ৪ শতাংশ। ফলস্বরূপ উদ্যোক্তারা এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়েছেন—রাষ্ট্রের ঘোষিত প্রণোদনা কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

একজন রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আমাদের বলে, ইএফপিএ ঋণ এখন বন্ধ; কিন্তু একই ব্যাংক পরদিন তাদের নিজেদের তহবিলের ঋণ অফার করে ১৫ শতাংশ সুদে। এটা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থ নয়, এটা পলিসির অপব্যবহার।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, তহবিলের মোট অর্থের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশই এখন ব্যাংকগুলো ব্যবহার করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও ব্যাংকগুলো সেই টাকা রপ্তানিকারকদের দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা টাকা নিজেদের কাছে ধরে রেখেছে, বিতরণ করছে না।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই তহবিল রপ্তানিকারকদের জন্য লাইফলাইন হওয়ার কথা ছিল। অথচ ব্যাংকগুলো এটাকে নিজেদের সুবিধার খাতায় ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং না থাকলে এভাবে সরকারি প্রণোদনা মাঠে নামবে না।’

বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে দুটি বাস্তব কারণ কাজ করছে—এক, ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের ঋণে লাভ বেশি পায়; দুই, তহবিল বিতরণে কোনো বাধ্যবাধকতা বা জরিমানা না থাকায় তারা নির্লজ্জভাবে অলস রাখছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘রপ্তানি সহায়তার এই সস্তা ঋণের অর্থ যদি অলস পড়ে থাকে, তাহলে তহবিল গঠনের লক্ষ্যই ব্যর্থ হবে। এতে শুধু রপ্তানিকারকেরাই নয়, পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো ব্যাংক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এই তহবিলের ঋণ বিতরণে গড়িমসি করে এবং পরিবর্তে নিজেদের উচ্চ সুদের ঋণ চাপিয়ে দেয়, তবে ব্যবসায়ীরা যেন সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ জানান। আমরা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’

তবে ব্যাংকারদের একাংশ জানাচ্ছেন, তহবিলের শর্ত জটিল এবং ফেরত দেওয়ার সময়সীমা কম হওয়ায় তারা ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নন। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এটি ব্যাংকগুলোর সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা বলে মন্তব্য করছেন। কারণ, ইএফপিএ ঋণের ঝুঁকি মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক বহন করে, তবু ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চাচ্ছে না। ফলস্বরূপ, এই তহবিলের উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ার পথে। রপ্তানিকারকরা কাঁচামাল আমদানির জন্য মূলধন না পেয়ে উৎপাদন কমাচ্ছেন, অথচ ব্যাংকগুলো অলস অর্থের ওপর ভর করে উচ্চ সুদের ঋণ বিক্রিতে বেশি মনোযোগী।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!