সরকারি জমি নিয়ে দুই ব্যাংকের দখল–নিলাম

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় গণপূর্তের লিজ দেওয়া কার পার্কিংয়ের জমিটি আবারও আলোচনায় এসেছে। ঋণ আদায়ের জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংক সরকারি এই জমি নিলামে তুলেছে। অন্যদিকে, তিন তারকা হোটেল নির্মাণের জন্য লিজ পাওয়া জমির ওপর নির্মাণাধীন ভবনের দুই ফ্লোর দখলে নিয়ে সেখানে অফিস চালু করেছে আরেক বেসরকারি ব্যাংক। লিজ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকে মামলা হলেও সরকারি এই জমি এখনো বেহাত হওয়া ঝুঁকি থেকে রক্ষা পায়নি। ব্যাংকগুলোর দাবি, জমিটির বিপরীতে নেওয়া ঋণ খেলাপি হওয়ায় বন্ধকি সম্পত্তি হিসেবে ভবনসহ জমি দখল ও নিলামের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ২৫ বছর আগে লিজ চুক্তির মাধ্যমে সাবেক প্রয়াত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নামে সরকারি জমিটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে সেই জমি হাতবদল হয়ে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণাধীন ভবনটি বন্ধক রেখে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক শত শত কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে, তবে জমির মূল মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখার ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, ঋণটি অনেক পুরোনো। আমাদের কাছে ট্রান্সফার হয়ে জমি ও ভবনের ফ্লোর মর্টগেজ হিসেবে এসেছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মর্টগেজ করা এই সম্পদ নিলামে বিক্রি করে পাওনা আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, বিষয়টি জেনেশুনেও কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেয়নি লিজদাতা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম গণপূর্ত ডিভিশন-১। সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকের লিজের ওই জমি নিলামে তোলার বিষয় নজরে আসার পর ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোকে লিজের শর্ত ভঙ্গের বিষয়ে অবগত করার পাশাপাশি জমিটি নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে লিখিত জানানো হবে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম গণপূর্ত ডিভিশন-১।

যেভাবে লিজে গেলো সরকারি জমি

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরের মাস্টারপ্ল্যানে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্লট ২২, ২৩, ২৪ এবং ৩৫, ৩৬, ৩৭ এর মধ্যবর্তী ২১/১ নম্বর প্লটে জনস্বার্থে কার পার্কিংয়ের জন্য ১ দশমিক ৪৪ বিঘা জায়গা রাখা হয়। আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ের আখতারুজ্জামান সেন্টার ও আগ্রাবাদ মোড়ের হোটেল সেন্টমার্টিনের মধ্যকার ওই জায়গাটিতে অত্যাধুনিক বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য বরাদ্দ পেতে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী বরাবর আবেদন করেন ওই সময়ের চট্টগ্রাম-৪ ফটিকছড়ি আসনের সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের ভাই ফখরুল আনোয়ার।

এখন যেহেতু নিলামে জমিটি তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রির কথা উঠছে, সেহেতু আমরা ব্যাংকগুলোকে লিজের শর্ত সম্পর্কে অবগত করে চিঠি দেওয়া হবে। পাশাপাশি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে লিখিত জানানো হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- গণপূর্ত ডিভিশন-১ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম খান তবে পরের ২৬ আগস্ট গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়- ‘বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যানজট নিরসনের জন্য আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার প্লট নম্বর ২২, ২৩, ২৪, ৩৫, ৩৬ ও ৩৭ এর মধ্যবর্তী কার পার্কের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি বিক্রি করা যাবে না। এ স্থানটি ঘেরাও করে অবিলম্বে গণপূর্ত অধিদপ্তর কার পার্ক স্থাপনের ব্যবস্থা নেবে।’ পরে ১৯৯৯ সালের ১১ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর ওই বছরের ৬ মে আগের ওই জায়গায় আন্তর্জাতিক মানের তিন তারকা হোটেল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে পুনরায় আবেদন করেন ফখরুল আনোয়ার। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৫ মে মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সভায় মন্ত্রী উল্লেখ করেন, ‘আগ্রাবাদ এলাকায় কার পার্কিংয়ের জন্য কার্যকর কোনো চাহিদা নেই।’ এসময় মন্ত্রী গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান স্থপতিকে বর্ণিত প্লটের নকশা পুনর্বিন্যাস করার নির্দেশ দেন।

সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর কমবেশি ১ দশমিক ৪৪ বিঘার প্লটটি ফখরুল আনোয়ারের হোটেল গোল্ডেন ইনকে প্রচলিত শর্ত ও লিজ দলিলের শর্তানুযায়ী একটি তিন তারকা বিশিষ্ট হোটেল নির্মাণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত দেয়। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ১৯৯৯ সালের ৯ জুন হোটেল গোল্ডেন ইনকে লিজ বরাদ্দ দেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। লিজ দলিলের প্রথম শর্ত ছিল ‘বরাদ্দ জমি হোটেল নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হবে। এছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে উক্ত জমি ব্যবহার করা যাবে না এবং বরাদ্দ প্লটের দখল বুঝে নেওয়ার দুই বছরের মধ্যে হোটেল নির্মাণ করতে হবে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলোচিত জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮ টাকা এবং লিজগ্রহীতার সঙ্গে লিজ-ডিড সম্পাদনের জন্য চট্টগ্রাম গণপূর্ত ডিভিশন-১কে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার আগেই ২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল বরাদ্দের শর্ত ভঙ্গ করে ফখরুল আনোয়ার প্লটটি হস্তান্তরের জন্য চার কোটি ৬১ লাখ ৯৯ হাজার টাকায় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান সানমার প্রপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিক মাসুক হকের (শাহীন) সঙ্গে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, চার কোটি ৬১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৩৭ দশমিক ৩৮ টাকার মধ্যে জমির সরকারি মূল্য ও অন্যান্য করের জন্য ১ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার ৭৮৯ দশমিক ৩৮ টাকা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ২ কোটি ৯২ লাখ ৭৮ হাজার ৭৪৮ টাকা ফখরুল আনোয়ারকে পরিশোধ করা হয়। পরে, সেই অর্থ তৎকালীন গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এমপি রফিকুল আনোয়ার ও ফখরুল আনোয়ার ভাগাভাগি করেছিলেন বলে দুদকের মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদকের মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে দেওয়া জবানবন্দিতে সানমার প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুক হক শাহীন বলেন, মেসার্স সানমার হোটেলস লিমিটেডের পুরো শেয়ারের মূল্য নির্ধারিত হয় চার কোটি ৬১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৩৭ টাকা। এর মধ্যে জমির সরকারি মূল্য ও লিজ-ডিড সম্পাদনে রেজিস্ট্রি খরচসহ ১ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার ৭৮৯ দশমিক ৩৮ টাকা এবং ২ কোটি ৯২ লাখ ৭৮ হাজার ৭৪৮ টাকা সানমার হোটেলস লিমিটেডের মালিকদের পরিশোধ করা হয়। পরে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মাসুক হক তার স্ত্রীর নামে হস্তান্তর করে নেওয়া হয়। পরবর্তীসময়ে ওই প্রকল্পে থ্রি স্টার হোটেল নির্মাণ করে সেখান থেকে লাভ অর্জন করা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ বিধায় কোম্পানির সব শেয়ার জয়েন্ট স্টক কোম্পানির মাধ্যমে সিলভিয়া গ্রুপের মালিক মিজানুর রহমান ও মুজিবুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এক ব্যাংকের নিলাম, অন্য ব্যাংকের দখল

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলভিয়া গ্রুপের মালিক দুই ভাই মিজানুর রহমান শাহিন ও মুজিবুর রহমান মিলন সানমার হোটেলস লিমিটেডের মালিকানা নিয়ে গণপূর্তের সেই প্লট মর্টগেজ দিয়ে ওই স্থানে ১০ তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেন। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে নেওয়া ঋণ সুদাসলে ১৭৫ কোটি টাকার বেশি দাঁড়িয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক তাদের কাছে বন্ধক জমি ও ভবন আদালতের আদেশে নিলামে বিক্রি করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। পরে তারা ভবনটির নিচতলা ও দ্বিতীয় দখল নিয়ে নিজেদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে। একইভাবে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখা ঋণের বিপরীতে সুদাসলে ২৩৭ কোটি ৭৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮০৪ টাকা আদায়ে বন্ধকি ভবনের ফ্লোর ও অংশ বিশেষ জমি নিলামে বিক্রির জন্য গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে অর্থঋণ আদালতের আদেশে গণপূর্তের সেই জমি এবং জমিতে নির্মাণাধীন মিসকাত আর্কেড নামে ভবনটির ১০ তলার ১৩ হাজার ২৪৬ বর্গফুট ফ্লোর এবং অংশবিশেষ তিন দশমিক শূন্য আট শতাংশ জমি নিলামে বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখার ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ঋণটি অনেক পুরোনো। আমাদের কাছে ট্রান্সফার হয়ে জমি ও ভবনের ফ্লোরটি মর্টগেজ হিসেবে এসেছে। আদালতের নির্দেশে মর্টগেজ করা সম্পদ নিলামে বিক্রির মাধ্যমে আমাদের পাওনা আদায়ের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’ তবে মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। গণপূর্ত ডিভিশন-১ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আগ্রাবাদ কার পার্কিংয়ের জায়গাটিতে হোটেল করার জন্য লিজ বরাদ্দ দেওয়ার ঘটনাটি ২০০০ সালের। হোটেল নির্মাণের জন্য জমিটি লিজ দেওয়া হয়েছিল। দুই বছরের মধ্যে হোটেল নির্মাণ করার কথা ছিল। ওই নথি পর্যালোচনা করে দেখেছি, ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেহেতু নিলামে জমিটি তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রির কথা উঠছে, সেহেতু আমরা ব্যাংকগুলোকে লিজের শর্ত সম্পর্কে অবগত করে চিঠি দেওয়া হবে। পাশাপাশি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে লিখিত জানানো হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!