বিশ্বের কোথাও সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত নেই। তবে বাংলাদেশে এমন একটি ব্যাংক গঠনের আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ‘সরকারি কর্মচারী ব্যাংক’। জাতীয় বেতন কমিশন সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বেতনভোগী একটি টেকসই শ্রেণি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাঁদের জন্য পৃথক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ও সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে সভাপতি করে গত ২৭ জুলাই জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। এ কমিশনই সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী।
বেতন কমিশনের সভাপতি জাকির আহমেদ খান গত মঙ্গলবার বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক গঠনের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। কমিশনের প্রতিবেদনে এ সুপারিশ থাকতে পারে, আবার না–ও পারে।তবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক করতে বর্তমান বেতন কমিশনই যে প্রথম চিন্তা করছে, তা নয়। ফরাসউদ্দিন কমিশনও সরকারি কর্মচারীদের জন্য এ ধরনের সুপারিশ করেছিল।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় বেতন কমিশন এর আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একই ধরনের সুপারিশ করেছিল। বিষয়টি পরে অবশ্য আর এগোয়নি। সুপারিশটি ছিল, রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ের কাছাকাছি থাকা সরকারি জমি থেকে ২০-২৫ কাঠা জমি বিক্রি করে একটি ব্যাংক গঠন করা হবে। তখন ‘সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক’ শীর্ষক একটি নামও দেওয়া হয়েছিল। সুপারিশে বলা হয়েছিল, প্রস্তাবিত ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন হবে ৪০০ কোটি টাকা।
জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বাধীন নতুন জাতীয় বেতন কমিশনের কার্যপরিধিতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যমান বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পর্যালোচনাসংবলিত সুপারিশ করার কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কোনো কথা নেই কার্যপরিধিতে। তারপরও প্রতিবেদনে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
বেতন কমিশনের প্রভাবশালী সদস্যরা সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাঁদের মতে, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার-ভিডিপির নিজস্ব ব্যাংক রয়েছে, তাই ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর জন্যও একটি পৃথক ব্যাংক গঠন করা যৌক্তিক। বর্তমানে তাঁদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। আরও বলা হচ্ছে, সরকারি কর্মচারীরা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) ব্যবস্থায় বেতন পান। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বদলি হলে ব্যাংক হিসাব পরিবর্তনের কারণে বেতন পেতে দেরি হয়। যদি শুধু সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি ব্যাংক থাকত, তাহলে এই সমস্যা আর থাকত না।
ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থাও থাকবে প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী ব্যাংকে। এখন যেমন সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গৃহনির্মাণ ঋণ নিতে হয়, আলাদা ব্যাংক হলে আর এ পেরেশান পোহাতে হবে না। এমনকি সুদের হারও কম রাখা সম্ভব হবে। বেতন কমিশনের সদস্যদের কেউ কেউ অবশ্য বিদ্যমান কোনো দুর্বল ব্যাংককে সরকারি কর্মচারী ব্যাংকে রূপান্তরের পরামর্শ দেন বলে জানা গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকের সঙ্গে গত মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিশেষ গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক চারটি ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে লাইসেন্স পায় আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের উদ্যোগে ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০১৬ সালে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জন্য সীমান্ত ব্যাংক এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানায় কমিউনিটি ব্যাংককে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে লাইসেন্স প্রদান করা হয়।
বর্তমানে দেশে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে, যার মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক। রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগ সরকার কয়েক দফায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দিয়েছে। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একবার বলেছেন, প্রয়োজন না থাকলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এতগুলো লাইসেন্স দেওয়া হয়। এই ধরনের অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক লুটপাট হওয়ায় পুরো ব্যাংক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকার ইসলামি ধারার পাঁচটি ব্যাংক নিয়ে একটি নতুন ব্যাংক গঠনের কাজ শুরু করেছে।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক গঠন করা ঠিক হবে কি না, জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘চিন্তাটির কথা শুনে আমি একটু অবাক হয়েছি। দুনিয়ার কোথাও এ রকম ব্যাংক নেই। দেশে যত ব্যাংক আছে, সেগুলোই বেশি। নতুন কোনো ব্যাংক করার চিন্তা থেকে সরে এসে সরকারের উচিত হবে বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম কীভাবে আরও ভালো করা যায়, সেই উদ্যোগ নেওয়া।’

