বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল তারকা সাকিব আল হাসান। তাকে ২০০৯ সালে ‘উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালামনাক’ বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার এবং একদিনের ক্রিকেটের দশকের (২০১০-২০) সেরা ক্রিকেটার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সম্মান শুধু সাকিবকে নয়, সমগ্র দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদেরও গর্বিত করেছে। তবে মাঠের বাইরে নানা কর্মকাণ্ডের কারণে তার খ্যাতি প্রায়শই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্য তাকে ক্রীড়াঙ্গনে নিষিদ্ধও হতে হয়েছে। রাজনীতি এবং শেয়ারবাজারের জটিলতায় জড়িয়ে পড়া, এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কারণে তিনি কখনো কখনো সমালোচনার মুখে পড়েন। জানা গেছে, সাকিব কর ফাঁকিতেও পিছিয়ে নেই। ব্যাংকের এফডিআর, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, আমানতের সুদ বা দেশ-বিদেশের ক্রিকেট লিগ থেকে অর্জিত আয়ের তথ্য তিনি গোপন করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর তদন্ত গোয়েন্দা ইউনিট ১০৬ কোটি টাকার বেশি আয়বহির্ভূত অর্থের সন্ধান পেয়েছে, যার মধ্যে কর ফাঁকির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকার বেশি।
আয়কর নথি অনুযায়ী, সাকিবের আয়ের মূল উৎস হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চুক্তিভিত্তিক বেতন, বিজ্ঞাপন থেকে অর্জিত আয় এবং ব্যাংকে থাকা কিছু স্থিতি। এছাড়া একমাত্র ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) থেকে আয়ের তথ্য দেখানো হয়েছে ২০১৭-১৮ করবর্ষের জন্য, যদিও তিনি ২০০৮ সাল থেকে আইপিএলে অংশ নিচ্ছেন। পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইপিএল ছাড়াও সাকিব বিশ্বের প্রায় সব টি-২০ লিগে খেলেছেন। এর মধ্যে ২০১১-২০২১ সালের মধ্যে (২০১৩ সাল ব্যতীত) বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০২২-২৩ ও ২০২৫ মৌসুম, এলপিএলে ২০২৩ সালে, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) ২০১৩, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২২ মৌসুম, বিগ ব্যাশ লিগে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ মৌসুম, চ্যাম্পিয়নস লিগ টি-২০তে ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ মৌসুম এবং মেজর লিগ ক্রিকেটে (এমএলসি) ২০২৪ সালে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে এসব লিগ থেকে অর্জিত আয়ের কোনো তথ্যই তিনি আয়কর নথিতে দেখাননি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ বা ম্যান অব দ্য সিরিজ হিসেবে প্রাপ্ত পুরস্কারের অর্থও গোপন রেখেছেন।
গোয়েন্দারা সাকিবের আয়কর নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পেয়েছেন। তবে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে ২০২১-২২ আয়কর বছর থেকে সাকিবের এফডিআরের পরিমাণ কমতে শুরু করে। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, সাকিব তার জমানো অর্থ উত্তোলন করে দেশের বাইরে নিয়ে গেছেন।আমেরিকার নিউ ইয়র্কে তার বাড়ি থাকার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে টি-২০ বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্য দেশটিতে সফরে গেলে সাকিবের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করার খবর বহুলভাবে প্রচারিত হয়। তিনি নিজেও ইনস্ট্রাগ্রাম স্টোরিতে সেটির ছবি ও ভিডিও আপলোড করেন। এতে দেশের বাইরে সাকিবের আরো সম্পদের খোঁজ মিলতে পারে বলে আয়কর গোয়েন্দারা ধারণা করছেন। সাকিবের অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত এখনো চলমান আছে। বর্তমানে ‘সাকিব আল হাসান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও ‘সাকিব আল হাসান ক্যানসার ফাউন্ডেশন’ নামে দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আয়কর ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার আবদুর রকিব বলেন, সাকিবের কর ফাঁকির বিষয়ে তদন্ত চলমান আছে। ইতোমধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদের বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। মূলত ব্যক্তি পর্যায়ে আয়ের তথ্য গোপন করে রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন ও আদায়ে এই ইউনিট গঠন করা হয়। তদন্ত ইউনিট তাদের প্রথম ফাইলটি ওপেন করে সাকিবের নামেই। এখানেও তিনি ‘নাম্বার ওয়ান’। সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬-০৭ আয়করবর্ষ থেকে রিটার্ন দাখিল করেছেন সাকিব। তবে ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন জমা দেননি। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর সাকিবও দেশে অবস্থান না করার কারণে তিনি রিটার্ন জমা দেননি বলে ধারণা করছেন আয়কর কর্মকর্তারা। তবে দাখিল করা রিটার্নের মধ্যে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ আয়করবর্ষের রিটার্নের তথ্য যাচাই শুরু করেন আয়কর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করে এক আয়কর গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাকিবের সম্পদের খোঁজে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালক হিসেবে তার নাম পাওয়া গেছে; এ পর্যন্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করা হয়েছে। তবে ফাইলে দেখানো হয়েছে মাত্র ৯টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১১টির পরিচালক পদ তিনি ত্যাগ করেছেন। এছাড়া ৯টি কোম্পানির জন্য একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে—১০/২ গাউসিয়া কাশেম সেন্টার। ৫০০ বর্গফুটেরও কম পরিসরের একটি কক্ষে এতগুলো কোম্পানির নিবন্ধন শুধুমাত্র শেয়ার ব্যবসার জন্য নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্য কেউ সাকিবের নাম ব্যবহার করে সুবিধা নিতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন ওই কর্মকর্তা। এছাড়া শেয়ারবাজারের আলোচিত ব্যবসায়ী হিরোর স্ত্রী কাজি সাদিয়া হাসানের মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি ব্রোকারেজ হাউসের মালিকানাও সাকিবের রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ করবর্ষে ২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আয়কর দেখানো হয়। ওই বছরে ছয় কোটি ৫৭ লাখ টাকা এফডিআর এবং সুদ বাবদ এক কোটি ৯২ লাখ টাকা আয় গোপনের তথ্য মিলেছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্যও দেখানো হয়নি। ২০২১-২২ করবর্ষে শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ছয় কোটি ৫৭ লাখ টাকা। সূত্র আরো জানায়, সাকিবের নামে কোনো গাড়ি নেই। একসময় দুটি গাড়ি দেখানো হলেও পরে সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি যেসব গাড়ি ব্যবহার করেন, সেগুলো তার প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত। এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সিকিউরিটিজ হাউস থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় সাকিবের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ লাখ ৮৮ লাখ টাকা। র্যাংকন থেকে ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট কেনেন, যা ২০২৩ সালে তার নামে হস্তান্তর করা হয়েছে সেটিও আয়কর নথিতে নেই। এভাবে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ করবর্ষ পর্যন্ত সাকিবের আয়বহির্ভূত ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ১০৬ কোটি টাকা।
কয়েকটি সূত্র জানায়, সাকিব ২০১৮ সালের নভেম্বরে রাজনীতিতে নাম লেখান। ওই সময় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাগুরা-১ আসন থেকে একই দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। ‘রাতের ভোট’ নামে খ্যাত ওই নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিতও হন। তবে ২০২৩ সালে সংসদ সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। খেলার মাঠে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। তবে সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফের আলোচনায় আসে তার নাম। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বরাবরই সাকিবের জাতীয় দলে ফেরার বিরোধিতা করে আসছেন। সে হিসেবে সাকিব আগামীতে দেশের হয়ে খেলতে পারবেন তা নিশ্চিত নয়।
বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন এই ক্রীড়াবিদ। তিনি শেষবার গত বছরের নভেম্বরে দেশে ফিরেছিলেন, বিসিবির সঙ্গে চুক্তি বিষয়ে আলোচনার জন্য। তবে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় আবার দেশ ছাড়েন। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় আছেন। সাকিবের সম্পদ সম্পর্কিত তথ্য এবং আয়কর ফাঁকির বিষয়ে জানতে তার আইনজীবী আবদুস সবুরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি এবং মেসেজের জবাবও দেননি।
** সাকিবের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিতে ২ মাস সময় পেল দুদক
** সাকিব-হিরুর ব্যাংক হিসাব স্থগিত চেয়ে দুদকে চিঠি
** শেয়ার কারসাজিতে আবারও সাকিবকে জরিমানা
** সাকিবসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
** সোনালীতে কারসাজি, সাকিবকে ২ কোটি জরিমানা
** দুদকের সাবেক দূত সাকিব হতে পারেন আসামি
** সাকিব আল হাসানের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ
** কর অঞ্চলে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ
** বিদেশে ভরপুর সম্পদ, আয়কর নথিতে নেই
** ১৮৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ১৮৭৪ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটন
** ‘ট্যাক্স এক্সপার্ট’র সহায়তায় পাচারের অর্থে আদায় হবে কর
** ১৬৫৭২ অভিযান, ৯৯৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়

