ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী ও টাকা পাচারের দায়ে সন্দেহভাজন ব্যবসায়ীদের কোম্পানির নামে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। একই সঙ্গে কোম্পানি পরিচালনায় চলতি মূলধন বা মেয়াদি ঋণ কিংবা বাণিজ্যিক ঋণের কিস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে ব্যাংকগুলো অর্থ পাচার বন্ধে এলসি খোলার পাশাপাশি এলসির দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থ পাচার বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর অবস্থান নেওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাকগুলোও নড়েচড়ে বসেছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোও নতুন এলসি ও ঋণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ শুরু করেছে।
অপরদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পরিষ্কার একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থে সব ধরনের লেনদেন চলবে। কিন্তু ব্যাংকগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ব্যবসায়িক লেনদেন আড়ালে কোনো হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন হবে না এবং কোনো হিসাব থেকে বা আমদানির এলসির দেনা পরিশোধ কিংবা রপ্তানির আড়ালে কোনো টাকা পাচার হবে না। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এই ধরনের কোনো অপরাধের ঘটনা ধরা পড়ে- তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সতর্ক বার্তার পর ব্যাংকগুলো আরও কঠোর হয়েছে।
এ অবস্থায় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের এলসি খোলার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে রয়েছে-সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত, শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলম গ্র“প, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পারিবারিক কোম্পানি। এছাড়াও গত সরকারের আমলে বড় অঙ্কের জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত অ্যানন টেক্স গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপের কোম্পানিগুলোও এলসি খুলতে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।
এর বাইরে সন্দেহভাজন হিসাবে যেসব সাবেক মন্ত্রী, এমপি বা ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে জব্দ বা স্থগিত করা হয়েছে ওইসব ব্যক্তিদের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর এলসি খোলার ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো কড়াকড়ি আরোপ করেছে। সন্দেহভাজন হিসাবে যেসব ব্যবসায়ীকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর এলসি খোলা ও ঋণের অর্থ ছাড়েও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ওইসব ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর নামে রপ্তানি ও আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা দেশের ক্ষতি করে নিজেরা লাভবান হয়েছেন। তারা যাতে আর কোনোভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার করতে না পারেন সেজন্য জরুরিভাবে এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেসব এলসির দায় শোধ করা হয়নি সেগুলোর অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে এখন বিলম্ব করার পাশাপাশি দেশে পণ্য এসেছে কিনা, আসলে পরিমাণ সঠিক আছে কিনা বা পণ্যের আন্তর্জাতিক দামের চেয়ে বেশি দাম দেখানো হয়েছে কিনা এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব তথ্য ব্যাংক নিশ্চিত হলেই কেবল দায় শোধ করা হচ্ছে। যে কারণে আগের এলসির নিষ্পত্তি বিলম্ব হচ্ছে, নতুন এলসি খোলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে চলতি মূলধন ও মেয়াদি ঋণের অর্থ ছাড়েও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কারণ এসব হিসাব থেকে টাকা পাচার হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ কারণে এসব খাতেও ঋণের অর্থ ছাড়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
ব্যাংক সূত্র জানায়, সন্দেহভাজনদের এলসি খোলা, এলসির অর্থ পরিশোধ ও ঋণের অর্থ ছাড়ের আগে নানা সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাতে ওইসব অর্থ ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হয় সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে। অন্য কোনো খাতে স্থানান্তর করা না হয়। এমনকি টাকা ছাড় হওয়ার পর ব্যাংকগুলো তা কঠোরভাবে তদারকি করছে, কোন খাতে টাকা খরচ হচ্ছে তাও দেখছে।