সাবেক এমপিদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি গাড়ি হাতিয়ে নিতে একটি সিন্ডিকেট কারসাজি করেছিল। বিষয়টি টের পেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরবর্তী নিলাম স্থগিত করে। এনবিআরের নির্দেশে এখন ওই ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের দাবি, এতে গাড়িগুলোর বিষয়ে সঠিক সমাধান হচ্ছে।
কাস্টমসের নিলাম সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি এসব গাড়ির ই-নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিন্ডিকেটের সদস্যরা নামেমাত্র দর দিয়ে কারসাজির চেষ্টা করেন। পরিকল্পনা ছিল, পরবর্তী নিলামে সামান্য বেশি দর দিয়ে গাড়িগুলোর মালিকানা নেওয়া। ওই নিলামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা সাবেক এমপিদের ২৪টি বিলাসবহুল গাড়িসহ মোট ৪৪টি গাড়ি নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। বর্তমানে এই ২৪টির সঙ্গে আরও ছয়টি যোগ হয়ে মোট ৩০টি গাড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। নিলামের ৪৪টি লটে ১৩৩টি দরপত্র জমা পড়ে, তবে ১১টি লটে কোনো দরপত্র পড়েনি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকার পরিবর্তনের ফলে দ্বাদশ সংসদের সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় ১০ কোটি টাকার বিলাসবহুল গাড়িগুলো খালাস করতে পারেননি। সংসদ ভেঙে যাওয়ায় সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন তারা। গাড়িগুলো নিলামে বিক্রি হলে সরকারের রাজস্ব আয় হতো প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম নিলামে কাস্টমস কর্মকর্তারা দেখেন, ১০ কোটি টাকার নামিদামি ব্র্যান্ডের এসব গাড়িতে নামেমাত্র দর পড়েছে—কোথাও ৫০ হাজার, কোথাও সর্বোচ্চ ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এমনকি কিছু গাড়িতে কোনো দরই পড়েনি।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, প্রথম নিলামে সংসদ সদস্যদের গাড়িতে যা দর পড়েছে, সেগুলো দ্বিতীয়বার নিলামে তোলা হলে বিক্রির সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে প্রথমবারের চেয়ে বেশি দর দিতে হবে এবং সর্বোচ্চ দরদাতা হতে হবে। এ হিসাবে পরেরবার নিলামে তোলা হলেই বিক্রি করা যেত গাড়িগুলো। নিলামের অংশগ্রহণকারীদের এ কারসাজি বুঝে ফেলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এর পর থেকে জোর দাবি ওঠে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের গাড়িগুলো ব্যবহার করার।
এদিকে কাস্টমসের আইনে, নিলামের ক্ষেত্রে লটের বেঁধে দেওয়া মূল্যের ৬০ শতাংশ পূর্ণ হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রথম নিলামে ওই শর্ত পূর্ণ না হলে দ্বিতীয় নিলামে ওই একই লটে প্রথম নিলাম থেকে বেশি দর দিলেই পণ্য চালান খালাস দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ সুযোগটি কাজে লাগায় নিলামে অংশ নেওয়া সিন্ডিকেট। এবার শুল্কমুক্ত আনা গাড়ির ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিল সিন্ডিকেটটি। তাই প্রথম নিলামে নামেমাত্র দর দিয়ে পরবর্তী দ্বিতীয় নিলামে গাড়িগুলো হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
গত ১১ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে গাড়ি নিলাম বিষয়ে মতামত চেয়ে এনবিআরে চিঠি পাঠানো হয়। এর পর ২৪ মার্চ এনবিআর জানায়, গাড়ি নিলামের সব কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। ফলে এমপিদের গাড়িসহ সব ধরনের নিলাম বন্ধ হয়ে যায়। পরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের নতুন নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। অবশেষে ২৮ সেপ্টেম্বর এনবিআর থেকে চিঠি আসে, যেখানে জানানো হয়—দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থ বিভাগের অনুমোদন এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়িগুলো সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার নথিপত্র অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়িগুলোর মধ্যে ২৬টি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার এবং ৪টি জাপানি টয়োটা হ্যারিয়ার রয়েছে। এসব গাড়ি আমদানি করেছিলেন সাবেক এমপি ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের মোহাম্মদ সাদিক, ময়মনসিংহ-৭ আসনের এ বি এম আনিসুজ্জামান, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মজিবুর রহমান ও জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতসহ মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সানজিদা খানম, এস এম কামাল হোসেন, মো. আসাদুজ্জামান, নাদিয়া বিনতে আমিন, শাহজাহান ওমর, অনুপম শাহজাহান জয়, সাজ্জাদুল হাসান, সাদ্দাম হোসেন (পাভেল), তারানা হালিম, সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নাসের শাহরিয়ার জাহেদী, আখতারউজ্জামান, আবুল কালাম আজাদ, রুনু রেজা, তৌহিদুজ্জামান, শাহ সারোয়ার কবীর, একরামুজ্জামান, আল মামুন, আবদুল মোতালেব, শাম্মী আহমেদ ও আব্দুল ওয়াহেদ।
এর মধ্যে ২০২৪ সালে জাপানে তৈরি ৩৩৪৬ সিসি ল্যান্ড ক্রুজার জেডএক্স মডেলের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি রয়েছে ২৪টি। এর প্রতিটির সংরক্ষিত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। এ ছাড়া ২০২১ সালে জাপানে তৈরি ২৬৯৩ সিসি ল্যান্ড ক্রুজার টিএক্স মডেলের গাড়ি রয়েছে ২টি। এর মধ্যে একটির সংরক্ষিত মূল্য ১ কোটি ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪ টাকা এবং অন্যটি ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ১২১ টাকা।
** বিলাসবহুল ৩০ গাড়ি সরকারকে দিচ্ছে এনবিআর
** ‘সংসদ সদস্যদের দামি গাড়ি বিক্রিতে নতুন সিদ্ধান্ত’
** শুল্কমুক্ত ২৪ গাড়ি হাতিয়ে নিতে সিন্ডিকেটের ফাঁদ
** আবার নিলামে উঠবে এমপিদের ৩০ গাড়ি
** দশবার নিলামেও বিক্রি হয়নি ৪৪ ‘ভিআইপি’ গাড়ি
** শুল্ক সুবিধায় আনা দামি গাড়ি পড়ে আছে রাস্তায়

