নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নে যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে, তা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করেই মেটানো সম্ভব বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ। তাদের মতে, নতুন কাঠামোতে বেতন–ভাতা বাড়ানোয় সরকারের ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং এর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। সম্প্রতি জাতীয় পে-কমিশনকে এ মতামত জানিয়েছে অর্থ বিভাগ। এর আগে পে-কমিশন নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন ও এর ফলে সৃষ্ট আর্থিক চাপ মোকাবিলার বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত চেয়েছিল।
অর্থ বিভাগের মতে, ২০১৫ সালের পর গত এক দশকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা আর বাড়ানো হয়নি। ফলে বর্তমান বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাস এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাড়তি অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে অর্থ বিভাগ। পে-কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংকটকালীন সময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন–ভাতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার নতুন পে-কমিশন গঠন করেছে। তবে অর্থের সংস্থান নিয়ে কিছুটা উদ্বেগে রয়েছে পে-কমিশনও। সংশ্লিষ্টদের মতে, মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় এবার বেতন বাড়ানোর হার শতভাগ পর্যন্ত হতে পারে। কারণ ২০১৫ সালের পর থেকে নতুন কোনো কমিশন গঠন হয়নি। যদিও প্রতি বছর চাকরিজীবীরা ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে আসছেন, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা এখন কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন। তবে বেতন যদি দ্বিগুণ হারে বাড়ানো হয়, তাহলে সরকারের ব্যয়ও এ খাতে দ্বিগুণ হবে, যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর।
বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় পে-কমিশনের সভাপতি সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খান বলেছেন, আমাদের হাতে সীমিত সম্পদ আছে। এর মধ্য থেকে সর্বোচ্চ বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব থাকবে। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের মধ্যেই গ্যাজেটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে, পরের রাজনৈতিক সরকার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে না। আর সেটি বাস্তবায়নের জন্য অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হবে চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে। তিনি আরও বলেন, আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিলে নতুন পে-স্কেল যদি কার্যকর করতে হয়, তাহলে চলতি অর্থবছরের বাজেটেই সেজন্য অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। বাজেট সংশোধন শুরু হবে ডিসেম্বরে, সেখানে নতুন পে-স্কেল কার্যকর করার বিধান যুক্ত করা হবে।
নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান করতে অর্থ বিভাগ দুটি প্রধান উৎসের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে—চাকরিজীবীদের বাড়িভাতা ও আয়কর। বর্তমানে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ৮ হাজার ২৫০ টাকা হলেও নতুন কাঠামোতে তা ১৬ হাজার টাকার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সর্বনিম্ন বেতনপ্রাপ্ত কর্মচারীরাও আয়করের আওতায় আসবেন, যারা এতদিন করমুক্ত ছিলেন। অর্থ বিভাগের ধারণা, এই নতুন কাঠামোতে সর্বনিম্ন বেতনধারীদের কাছ থেকেও সরকারের আয়কর রাজস্ব উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। ফলে এটি নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থের জোগান দিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
দ্বিতীয় উৎস হিসেবে অর্থ বিভাগ উল্লেখ করেছে চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়া। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের একটি বড় অংশ সরকারি আবাসনে থাকেন। বেতন কাঠামো সমন্বয়ের পর এসব বাসাবাড়ির ভাড়ার হার বাড়বে, ফলে ওই খাত থেকেও সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। অর্থ বিভাগের মতে, বেতন–ভাতা বাড়ানোর ফলে শুধু ব্যয় নয়, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অর্থ বিভাগের মতামতে আরও বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতি এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রগতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মুখোমুখি। পাশাপাশি ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। এসব প্রেক্ষাপটে সরকারি প্রশাসনে দক্ষ ও মেধাবী জনবল আকৃষ্ট করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক ও সময়োপযোগী বেতন কাঠামো প্রবর্তন প্রয়োজন, যা সরকারি চাকরিজীবীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, জনসেবা উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
জানা গেছে, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকরী নতুন বেতনকাঠামোর সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত বেতন কমিশনের কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে অনলাইনে চারটি প্রশ্নমালায় প্রাপ্ত সর্বসাধারণের মতামত ও সুপারিশ যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।বর্তমানে অ্যাসোসিয়েশন বা সমিতি কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত বা সুপারিশ প্রদান করেছে। প্রাপ্ত সুপারিশ ও মতামত কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। কমিশন আশা করছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই বেতন কমিশনের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করা সম্ভব হবে।
** নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন হলে যেসব সুবিধা বাতিল হবে
** নতুন পে-স্কেল ঘোষণা পেছাচ্ছে
** নবম পে-স্কেলসহ ৫০% মহার্ঘ ভাতার দাবি
** নতুন বেতন কাঠামোর প্রস্তাব: ২৫০০০ থেকে ১.৫ লাখ
** নতুন বছরের শুরু থেকেই নতুন পে–স্কেল কার্যকর!
** সচিবালয়ের কর্মচারীরাও পাবেন রেশন সুবিধা

