রাজস্ব আয় বাড়াতে বেশি গুরুত্ব আইএমএফের

বিদেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আর ‘কম ঝুঁকি’র নয়, বরং ‘মধ্যম ঝুঁকি’র দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ফলে সরকারি ব্যয় মেটাতে ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণ আরও কমানোর তাগিদ দিয়েছে ঢাকা সফররত আইএমএফ মিশন। গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে এসব পরামর্শ তুলে ধরে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিশনের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে ঋণের অনুপাতে রাজস্ব আহরণ খারাপ অবস্থায়। জিডিপির অনুপাতের চেয়ে রাজস্ব আয়ের সঙ্গে ঋণের তুলনা বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ রাজস্ব দিয়েই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। মিশন বলেছে, সরকারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে ঋণ করার প্রবণতা কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শুরু থেকেই রাজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এখন সেই তাগিদ আরও বেড়েছে। কারণ, কর রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় আইএমএফের নির্ধারিত শর্ত অর্জনে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। পরবর্তী কিস্তির প্রায় সব শর্ত পূরণ হলেও কর রাজস্ব ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। রাজস্ব বৃদ্ধিতে প্রত্যাশিত অগ্রগতি না থাকায় শর্ত হিসেবে বিদেশি ঋণ গ্রহণে একটি সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়েছে আইএমএফ। ৫৫০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় সংস্থাটির নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৮৪৪ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ নিতে পারবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের সর্বশেষ ডেট সাসটেইনিবিলিটি অ্যানালাইসিসের (ডিএসএ) ওপর ভিত্তি করে বিদেশি ঋণের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিএসএতে বাংলাদেশকে ‘মধ্যম ঝুঁকি’র দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘কম ঝুঁকি’র দেশ থেকে বাংলাদেশকে ‘মধ্যম ঝুঁকি’র দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে, রপ্তানি ও রাজস্ব আয়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। অর্থ বিভাগের প্রাক্কলন, চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা।

আপাতত নীতি সুদহার না কমানোর পরামর্শ

উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকায় নীতি সুদহার কমানো থেকে আপাতত বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে তারা এ সুপারিশ তুলে ধরে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মিশন। তাদের মন্তব্য, ঋণচাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো সাময়িকভাবে সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিলে বেশি বিনিয়োগ করে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বেসরকারি খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে আইএমএফ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে এক বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার সাত বিলিয়ন থেকে কমিয়ে এরই মধ্যে ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে নামানো হয়েছে। তবে বেশি মাত্রায় কমালে রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রিজার্ভ থেকে অন্য যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে তাও কমানো হবে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও চার ডেপুটি গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত অপর এক বৈঠক মূল্যস্ফীতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে গভর্নর বলেন, চালের দরের কারণে মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি। তবে দীর্ঘদিনে দুই অঙ্কের ঘর থেকে এখন কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান নীতি সুদহার কমাবে না।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় সংস্থাটির বিপিএম৬ ম্যানুয়াল অনুসারে রিজার্ভের হিসাবায়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে অনুযায়ী ইডিএফের ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার, গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডের ২০ কোটি, লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি তহবিলের তিন কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে দেওয়া চার কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনে (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখানো হয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিপিএম৬ অনুযায়ী, গত ৩০ অক্টোবর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ উঠেছে ৩২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানের এ রিজার্ভ গত ৩১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!