Header – Before
Header – After

ভোলার গ্যাসে নেই কোন তৎপরতা

দক্ষিণাঞ্চলের ভোলায় আরও ৫.১০৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে চার বছর গবেষণা চালানো রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রম এই গ্যাসের সন্ধান দিয়েছে। তবে দেশের বাইরে থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি ও ব্যবসায়িক সুবিধা দিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এই খবর জাতির কাছে জানাননি। অব্যাহত এই পরিস্থিতির কারণে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকারেরও তেমন উদ্যোগ নেই। ফলে দেশকে উচ্চমূল্যে গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে।

ভোলার বিভিন্ন গ্যাসকেন্দ্র পরিদর্শন করার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, সরকার ভোলার গ্যাস এলএনজি আকারে আনার ব্যবস্থা করবে। তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এলএনজি আকারে গ্যাস আনার আগ্রহ কম। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, শিল্প মালিকরা যে দাম দিতে ইচ্ছুক, তা অনুযায়ী এলএনজি আকারে গ্যাস আনা প্রায় অসম্ভব। সূত্র অনুযায়ী, প্রাক্কলিত দর ৫০ টাকা শুনেই অনেক ব্যবসায়ী আগ্রহ হারিয়েছেন। ১৬০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে মতামতের জন্য চিঠি পাঠানো হলেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি; কেউ ৩০ টাকা, কেউ ৪০ টাকায় গ্যাস কেনার কথা বলেছেন।

উপকূলীয় জেলাটি থেকে বর্তমানে এলএনজি আকারে দৈনিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের জন্য দেশের একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। এতে প্রতি ঘনফুটের পরিবহন খরচ ৩০.৬০ টাকা যোগ করে গ্যাসের মোট দাম দাঁড়াচ্ছে ৪৭.৬০ টাকা, যা পাইপলাইনের গ্যাসের তুলনায় প্রায় দেড় গুণ। চুক্তি থাকা সত্ত্বেও দেশীয় কোম্পানি ইন্ট্রাকো গড়ে মাত্র ২ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। এলএনজি বড় পরিমাণে আনা গেলেও প্রথমে ভোলায় প্রক্রিয়াজাত করতে হবে এবং তারপর প্রস্তাবিত নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গিয়ে পুনরায় রিগ্যাসিফিকেশন করতে হবে।

এভাবে ভোলা থেকে গ্যাস আনতে খরচ বেশি হবে, এমনটা জানিয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন ও মাইনস) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই জটিলতা চলছে। এই সংকট কাটাতে এলএনজি আকারে আনার কথা ভাবা হচ্ছিল। এ লক্ষ্যে ভোলা থেকে এলএনজি আকারে গ্যাস আনার বিষয়ে গ্যাজপ্রম, সিসিডিসি, সিএমসিসহ ৪টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহপত্রও জমা দিয়েছে। আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেছিলাম তাদের মতামত নেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন বিষয়টি বেশ জটিল মনে হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভোলা থেকে এলএনজি আকারে গ্যাস আনতে কী পরিমাণ পরিবহন খরচ পড়বে বিষয়টি এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এখনো অর্থনৈতিক প্রস্তাব জমা দেয়নি কোম্পানিগুলো। সিএনজি আকারে আনতে যেমন খরচ হচ্ছে, প্রায় কাছাকাছি খরচ হতে পারে এলএনজিতেও।’

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস এলএনজি আকারে আনার পরিকল্পনার কথা জানায়। ২০২৬ সালের শুরুতে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চূড়ান্ত করা হয় রোডম্যাপও। এ জন্য কয়েক দফায় ফিল্ড ভিজিটসহ অগ্রাধিকার দিয়ে নানান কর্মকা-ে জোর দেওয়া হয়। তবে পরিবহন খরচসহ সার্বিক বিবেচনায় এ পরিকল্পনায় ভাটা পড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে শুরু হয় পাইপলাইনে গ্যাস আনার তোড়জোড়। কারণ এলএনজি আকারে বেশি পরিমাণে গ্যাস আনার সুযোগ সীমিত থাকলেও পাইপলাইনের মাধ্যমে তা অবারিত থাকে। এলএনজি আকারে গ্যাস আনতে হলে অন্তত ১৫ বছরের জন্য চুক্তি করতে হয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

প্রস্তাবিত দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আকারে আনা হলে পাইপলাইনে সরবরাহ করার জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস থাকবে না। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে পাইপলাইনের বিনিয়োগ তোলা কঠিন হতে পারে। আবার ১৫ বছরের নিশ্চয়তা না পেলে বিনিয়োগকারীও আসতে চাইবে না। এদিকে এলএনজি আকারে আনতে হলে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস উত্তোলন করাও সম্ভব নয়। কূপ থেকে উত্তোলন করা হলে তা গ্যাস ফিল্ডের জন্যও হুমকি তৈরি হতে পারে।

নানান দিক বিবেচনায় এলএনজি রেখে পাইপলাইনের দিকে ঝুঁকে পড়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। আগের সরকারের পরিকল্পিত ভোলা-বরিশাল-খুলনার রুট পরিবর্তন করে চূড়ান্ত করেছে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা রুট। সংশোধিত রুটের প্রাক-সমীক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ভোলা-বরিশাল সমীক্ষা আগে করা হলেও সম্প্রতি নতুন করে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা রুটের প্রাক-সমীক্ষার জন্য ঠিকাদার চূড়ান্ত হয়েছে।

দেশে দৈনন্দিন গ্যাসের চাহিদার ঘাটতি মেটানোর জন্য কয়েকটি বিকল্প পথ রয়েছে: দ্রুত ভোলা-বরিশাল-ঢাকা পাইপলাইন বাস্তবায়ন, নতুন এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন এবং তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা। যদিও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কিছু অগ্রগতি হয়েছে, পাইপলাইন এবং এলএনজি টার্মিনালের ক্ষেত্রে অনেকেই সন্তুষ্ট নন। দেশে গ্যাস উৎপাদন কম হলেও আমদানি বৃদ্ধির পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। বিদ্যমান দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) দিয়ে সর্বোচ্চ দৈনিক ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি সম্ভব। নতুন এফএসআরইউ স্থাপনের জন্য দরপত্র চূড়ান্ত হলেও অন্তত ১৮ মাস সময় লাগবে। এছাড়া ল্যান্ডবেজড টার্মিনালের বিষয়ও দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত। মহেশখালীতে স্থান নির্ধারণের পর ২০১৯ সালে ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হয়েছে, যা কার্যাদেশ পাওয়ার পর ৮০ মাস সময় নেবে। এলএনজি টার্মিনালের অবস্থান নির্ধারণ নিয়েও চলছিল জটিলতা। তবে সম্প্রতি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান জানিয়েছেন, নতুন আরও দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের কাজ চলছে; একটির দরপত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং খুব শিগগিরই দরপত্র আহ্বান করা হবে। ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল সম্পর্কেও কাজ এগোচ্ছে।

দ্বীপ জেলা ভোলাতে ২টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোয় এরই মধ্যে ৯টি কূপ খনন করা হয়েছে, যেগুলোর দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু চাহিদা না থাকায় মাত্র ৭২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো উত্তোলন করা হয়েছে। আবার পাইপলাইন না থাকায় জাতীয় গ্রিডেও এ গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এদিকে ভোলায় আরও ১৫টি কূপ খননের লক্ষ্যে কাজ করছে পেট্রোবাংলা। পাইপলাইন বাস্তবায়ন ও প্রস্তাবিত কূপগুলো খনন শেষ হলে সেখান থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। সংশ্লিষ্টরা জানান, এক টিসিএফ গ্যাস দিয়ে দেশের এক বছরের গ্যাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

গ্যাজপ্রমের এক গবেষণার তথ্য মতে, ভোলার শাহবাজপুর ও ইলিশায় ২ দশমিক ৪২৩ টিসিএফ এবং চর ফ্যাশনে ২ দশমিক ৬৮৬ টিসিএফ মজুত গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। উত্তোলনযোগ্য ৫ দশমিক ১০৯ টিসিএফ গ্যাস স্পট মার্কেট এলএনজির দর হিসেবে (১০ দশমিক ৪৬ মার্কিন ডলার প্রতি এমএমবিটিইউ) প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ভোলার এই কূপগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হলে দৈনিক ৯২০ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা যাবে। এতে একদিকে দেশের গ্যাস সংকট যেমন দূর হবে, পাশাপাশি উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি নির্ভরতাও কমবে।

এই গ্যাস দিয়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও সম্ভব হবে। গ্যাজপ্রমের মুখপাত্র এলক্সি বেলবেজিয়াভ এ বিষয়ে এক অনুষ্ঠানে জানান, গবেষণাটি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা করা হয়েছে। যেখানে সিসমিক ডাটা, অয়েল লক ডাটা, কোর ডাটা বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত হয়েছে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার, সুপার কম্পিউটার সিস্টেম এবং উন্নত মানের ল্যাব ব্যবহার করার ফলে গবেষণার তথ্যগুলো খুবই নির্ভরযোগ্য। যার ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা অনেকাংশেই পূরণ হবে।’

পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২ হাজার ৬৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকছে এক হাজার ৩৬৭ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। স্বাভাবিক সময়ে দুটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে এক হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হতো। কিন্তু গত প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে সামিটের একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কম হচ্ছে। এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প-কারখানাসহ সব খাতেই গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে।

ভোলায় গ্যাসের মজুতের বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ভোলা এবং তার আশপাশে যে অঞ্চল আছে তা গ্যাসের জন্য খুব সম্ভাবনাময়। ভোলা দ্বীপে এরই মধ্যে তিনটি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার হয়েছে। এর একটি শাহবাজপুর, ভোলা নর্থ এবং আরও উত্তরে আছে ইলিশা। এই দ্বীপে আরও গ্যাসের মজুত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বীপটি গ্যাসসমৃদ্ধ একটি দ্বীপ।’ তবে সরকার বিষয়টি নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছে দাবি করে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, আমরা কয়েক দফায় ভোলার গ্যাসকেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছি। ওই এলাকায় পাইপলাইন তৈরি করা কঠিন তাই বিকল্প উপায় হিসেবে সিএনজি বা এলএনজি আকারেই গ্যাস আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদেরকিছুটা অনীহা রয়েছে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। দেশের গ্যাস সংকট কাটাতে ভোলার গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!