দেশে না আছে হীরার খনি, না হয় আমদানি—তবু হীরার ব্যবসা চলছে দেদারসে। বছরে এ খাতের আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ গত চার বছরে সরকারিভাবে আমদানি হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকার হীরা। এ অবস্থায় ‘ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড’ নামে দিলীপ কুমার আগরওয়ালার প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ঢাকাসহ সারা দেশে ২৮টি শোরুম। প্রতিদিন এসব শো-রুমে বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার হীরা। অভিযোগ রয়েছে, গত দেড় দশক ধরে চোরাই পথে আনা ভেজাল হীরার ব্যবসা করছেন তিনি। কোথা থেকে কীভাবে এসব হীরা আসে—সে প্রশ্নে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের বিক্রয়কর্মীরা স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি
ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি না হলেও দেশে ডায়মন্ডের বাজার দিন দিন বড় হয়েছে। ডায়মন্ডের গহনা বিক্রির শতাধিক দোকান রয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু স্বর্ণের দোকানেও ডায়মন্ডের গহনা বিক্রি হয়। এসব দোকানে বছরে কত টাকার ডায়মন্ডের গহনা বেচাকেনা হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। দেশের হীরার বাজার নিয়ে সমীক্ষা করা একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, ডায়মন্ডের গহনা বেচাকেনা হয় বছরে ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার। গড় বাজার হিসাব করা হলে বছরে তা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে ডায়মন্ড আমদানির সুযোগ নেই। তাহলে দেশের বাজারে বেচাকেনা হওয়া এত ডায়মন্ড কোথায় থেকে কীভাবে আসছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার হীরা ও হীরার গহনা আমদানি হয় দেশে। তবে এর পর থেকে হীরা আমদানি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পখাতে ব্যবহারের জন্য ২০১৯ ও ২০২০ সালে মাত্র তিনটি চালান ছাড়া কোনো জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান হীরা আমদানি করেনি। ২০২১ সালে অমসৃণ হীরা আমদানি করে দেশের একমাত্র কাটিং ও পলিশিং কারখানা ‘বেঙ্গল ডায়মন্ড লিমিটেড’, আর ‘কেয়া কসমেটিকস লিমিটেড’ আনে একটি ছোট চালান। ২০২২ সালে দুটি প্রতিষ্ঠান হীরা আমদানি করে—এর মধ্যে শিল্পকারখানায় ব্যবহারের জন্য ‘বিআরবি কেবল ইন্ডাস্ট্রিজ’ একটি চালান এবং ঢাকার ‘জুয়েলারি হাউস’ সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার ঘোষণায় আরেকটি চালান আনে। সব মিলিয়ে গত চার বছরে গড়ে বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার হীরা আমদানি হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আমদানির তথ্যমতে, গত ২০ বছরে যত ডায়মন্ড আমদানি হয়েছে, তার অধিকাংশই ভারত থেকে। ভারতের গুজরাটের সুরাটে বিশ্বের ৬৫ শতাংশের বেশি হীরা কাটিং ও পলিশিং করা হয়। খুব সহজে বহন করা যায় বলে দেশটি থেকে অবৈধভাবে আসছে হীরা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় কয়েক বছরে কয়েকটি চালান জব্দ করেছেন। ২০২১ সালে সাতক্ষীরা সীমান্তে পৌনে দুই কোটি টাকার ১৪৪টি হীরার গয়না জব্দ করে বিজিবি। ২০১৮ সালে ৭০ লাখ টাকার হীরার গয়না জব্দ করা হয়। অবৈধ পথে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব ডায়মন্ড দেশে আনছিলেন দিলীপ কুমার আগরওয়ালা।
জানা গেছে, বন্ড সুবিধা ছাড়া অমসৃণ ডায়মন্ড আমদানিতে কর ৮৯ শতাংশ। মসৃণ হীরা আমদানিতে কর ১৫১ শতাংশ। এই শুল্ক কর ফাঁকি দিতেই মূলত হীরা অবৈধ পথে আনা হচ্ছে। গত ২০ বছরে এই মূল্যবান রত্ন আমদানিতে সরকার নামমাত্র রাজস্ব পেয়েছে। ডায়মন্ডের বাজারে আরেকটি রহস্যজনক আচরণ হলো দেশের বাজারে দাম। এক ক্যারেট (০.২ গ্রাম) হীরার দাম ৭৯ হাজার টাকা। আর সবচেয়ে কম অর্থাৎ শূন্য দশমিক ১০ ক্যারেট ডায়মন্ডের দাম ৭ হাজার ৯১৪ টাকা। বাংলাদেশে নাকফুলসহ হীরার অলংকার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকার নিচে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, হীরার ক্ষুদ্র টুকরো ব্যবহার করা হলেও এত কম দামে হীরার গয়না পাওয়ার কথা নয়। এগুলো আসলে উন্নতমানের কাচের টুকরা। আমদানি না হলেও বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ডায়মন্ডের গহনা বিক্রি হচ্ছে দেশে। তারা আরও বলছেন, একশ গ্রাম পর্যন্ত গহনা আনার সুযোগ নিয়ে ডায়মন্ডের ব্যবসায়ীরা আরও বেশি ওজনের ডায়মন্ডের গহনা নিয়ে আসছে ভারত ও দুবাই থেকে। যদিও ৯০ শতাংশের বেশি ডায়মন্ডের গহনা ভারত থেকে আসছে চোরাই পথে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের উচিত এসব কীভাবে আমদানি হচ্ছে, তার কাগজপত্র চেক করা। তাহলেই তো বেরিয়ে আসবে আসল রহস্য। এছাড়া ডায়মন্ডের গয়না তৈরি করতে স্বর্ণ ব্যবহৃত হয়। মূল্যবান এ রত্ন বসানো হয় স্বর্ণের ওপর। স্বর্ণ আমদানির জট খুলেছে আগেই। স্বর্ণালংকারের দক্ষ কারিগরও রয়েছে দেশে। এখন ডায়মন্ড রপ্তানির বৈশ্বিক এ বড় বাজার ধরা গেলে বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আসবে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। এ জন্য নীতিসহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি অবৈধ পথে ডায়মন্ড আমদানি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন তারা।

