** মো. হিমেল কাওসার নিজ এলাকার মৃত মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনকে দাদা সাজিয়ে ভুয়া সনদ তৈরি করেছে
** মুক্তিযোদ্ধার কোটা না থাকার পরও নিয়োগ কমিটির প্রধান সাবেক এক এনবিআর সদস্য তাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ দিয়েছেন
** ভুয়া সনদে চাকরি নেয়ার বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হলেও সরকারি চাকরি বিধিতে ‘অসত্য’ তথ্য বা ‘ভুয়া সনদে’ চাকরি নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বিষয় বলা নেই
** চাকরি বিধিতে এই অপরাধের কোনো শাস্তির বিষয় উল্লেখ না থাকায় এনবিআরকে তদন্ত প্রতিবেদনসহ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে কর আপীল রাজশাহী থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে
মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় চাকরি নিয়েছেন। যাকে দাদা সাজিয়ে নাতি কোটায় চাকরি নিয়েছেন, তিনি আপন দাদা নন। তিনি ওই মুক্তিযোদ্ধার নাতি নন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নিয়ে এক বা দুই বছর নয়-দীর্ঘ এক যুগ বা ১২ বছর ধরে চাকরিও করে যাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ ব্যবহার করে কর আপীল অঞ্চল রাজশাহীতে চাকরি নেয়া ব্যক্তি হলেন মো. হিমেল কাওসার। জালিয়াতি করে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি কর আপীল অঞ্চল রাজশাহীর এক তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। আবার এই কর আপীলে মুক্তিযোদ্ধার মাত্র একটি কোটা, যাতে আরো একজন চাকরিও করছেন। কিন্তু মো. হিমেল কাওসারকে নিয়োগ কমিটি (সাবেক কর কমিশনার ও সাবেক এনবিআর সদস্য) মুক্তিযোদ্ধার কোটা না থাকার পরও চাকরি দিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। তবে জালিয়াতি করে চাকরি নেয়ার পরও চাকরি বিধিতে ‘অসত্য’ তথ্যও ‘সনদ জালিয়াতির’ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না থাকায় মো. হিমেল কাওসারের বিরুদ্ধে কর আপীল রাজশাহী কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। দিকনির্দেশনা চেয়ে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদনসহ কর আপীল রাজশাহী থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিজনেস বার্তার হাতে কর আপীল রাজশাহীর তদন্ত প্রতিবেদনসহ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নেয়ার প্রমাণাদি রয়েছে। তবে ভুয়া সনদে কর আপীলের মতো একটি আইনি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী নিয়োগ হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রমতে, মো. হিমেল কাওসার ২০১৩ সালের ২২ মে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহীর হরিপুর পবার মো. আসির উদ্দিনের ছেলে। একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনকে নিজের দাদা সাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় চাকরি নেন। কিন্তু তিনি ওই মুক্তিযোদ্ধার আপন নাতি নন। আর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিন তার আপন পিতামহ বা দাদা নন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নেন মো. হিমেল কাওসার। বিষয়টি এত বছর রাজশাহী কর আপীল অঞ্চল খোঁজ নেয়নি। এমনকি চাকরি হওয়ার পর কোনো কোটায় চাকরি নিলে তা তদন্ত করার কথা। কিন্তু অজানা কারণে এই কর আপীল অঞ্চল থেকে তদন্ত করে দেখা হয়নি। মানে দাঁড়ায় এই কর্মচারী হয় ঘুষের বিনিময়ে, না হয় অবৈধ উপায়ে, না হয় এনবিআরের কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ‘আত্মীয় কোটায়’ দুর্নীতির মাধ্যমে সে সময় মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

সূত্র আরো জানিয়েছে, চাকরি হওয়ার ১১ বছর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এনবিআর আয়কর বিভাগ সংশ্লিষ্ট সব কর অঞ্চল, আপীলে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কতজন, কত সালে, কিভাবে নিয়োগ পেলো-তা জানতে চিঠি দেয়। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহী কর আপীল থেকে এনবিআরকে চিঠি দিয়ে জানানো হয় যে, এই আপীল অঞ্চলে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় চাকরি নিয়েছেন। যার মধ্যে একজন মো. হিমেল কাওসার। মুক্তিযোদ্ধার সাথে হিমেল কাওসারের সম্পর্ক আছে কিনা-তা যাচাই না করেই ওই সময়ে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের কমিশনার খালেদ শারিফ আরেফিন এনবিআরে এই দুইজনের তথ্য পাঠায়। যাচাই না করেই কিভাবে এনবিআরকে এমন তথ্য পাঠালেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, চলতি বছরের ২৬ আগস্ট আব্দুল আউয়াল নামে এক ব্যক্তি মো. হিমেল কাওসারের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নেয়ার বিষয়টি জানিয়ে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ করার পরপরই রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। অভিযোগে বলা হয়, মো. হিমেল কাওসার বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনকে (পরিচিতি নম্বর-০১৮১০০০২৬২৭, বেসামরিক গেজেট-৩৯৭) নিজের আপন দাদা পরিচয় দিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকুরি নিয়েছেন। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই ও সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার আয়েশা বিনতে মিজানকে (সদর দপ্তর প্রশাসন) দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তার তদন্তে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদে মো. হিমেল কাওসার চাকরি নেয়ার সত্যতা পাওয়া যায়। পরে ২৮ সেপ্টেম্বর এই কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের কমিশনারের কাছে পেশ করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী মো. হিমেল কাওসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৩০ সেপ্টেম্বর রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের কমিশনার মুন্সী হারুনর রশীদ এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রেরণ করেছে।
আয়েশা বিনতে মিজানের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মো. হিমেল কাওসারের পিতা মো. আসির উদ্দিন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিন (পরিচিতি নম্বর-০১৮১০০০২৬২৭, বেসামরিক গেজেট-৩৯৭) এর পুত্র নন। পবা উপজেলা প্রশাসন ও নির্বাচন অফিস হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মো. হিমেল কাওসারের পিতা মো. আসির উদ্দিনের পিতার নাম মৃত সোলাইমান শেখ। অর্থাৎ মো. হিমেল কাওসারের পিতামহের নাম হেমাজ উদ্দিন নয়, সোলাইমান শেখ। স্থানীয়ভাবে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনের চার পুত্র ও চার কন্যা সন্তান রয়েছে। যাদের মধ্যে হয়েছে-জয়নাল আবেদীন, আকবর আলী, আশরাফুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, নূরজাহান, মনোয়ারা, আনোয়ারা, নাজনীন।
আবার মো. হিমেল কাওসারের পিতা মো. আসির উদ্দিনের পিতার নাম সোলাইমান শেখ। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিন সোলাইমান শেখের আপন ভাই ছিলেন। অর্থাৎ হেমাজ উদ্দিন মো. হিমেল কাওসারের আপন পিতামহ নন। এ বিষয়ে মো. হিমেল কাওসারকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে জবাব প্রদান করতে বলা হলেও তিনি জবাব প্রদান করেননি। এমনকি সময়ের জন্যও আবেদন করেননি তিনি। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নাই। অর্থাৎ মো. হিমেল কাওসার রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে সরকারি চাকুরি গ্রহণ করেছিলেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের মাধ্যমে চাকরি নেয়া হলে তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিতে হবে-সে বিষয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা, ২০১৮’-তে বা চাকরি বিধানের কোথাও কোনো নির্দেশনা নেই। সেজন্য রাজশাহী কর আপীল অঞ্চল এই কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক কর কমিশনার (পরে এনবিআর সদস্য হিসেবে অবসরে যাওয়া) খন্দকার মো. ফেরদৌস আলম রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে কর্মরত থাকাবস্থায় এই নিয়োগ কমিটির প্রধান ছিলেন। তিনি মো. হিমেল কাওসারকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি দিয়েছেন। শুধু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নয়, মুক্তিযোদ্ধার কোটা না থাকার পরও তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মো. হিমেল কাওসারকে চাকরি দিয়েছেন। রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরির একটি কোটা ছিলো। সেই কোটায় আগে থেকে একজন সেখানে কর্মরত ছিলেন। কোটা না থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মো. হিমেল কাওসারকে অবৈধভাবে চাকরি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়োগ কমিটির অন্য সদস্যরা জানলেও অজানা কারণে তা প্রকাশ পায়নি। তবে ওই আপীল অঞ্চলের কর্মচারীরা বিষয়টি জানতো। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন।
অপরদিকে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার চাকরি নেয়া, তদন্ত কমিটি হওয়া, প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি বিজনেস বার্তার কাছে স্বীকার করেন মো. হিমেল কাওসার। কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব না দেওয়ার বিষয়ও স্বীকার করেন তিনি। তবে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিষয়ে অন্য প্রশ্ন করার পরপরই মোবাইল ফোন কেটে দেন মো. হিমেল কাওসার।
এই বিষয়ে এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজনেস বার্তাকে বলেন, ভুল তথ্য দিয়ে চাকরি নেয়া হলে তা তদন্তে প্রমাণিত হলে চাকরি থাকার কথা নয়। তবে চাকরি হওয়ার পরপরই চাকরি প্রার্থীর সব তথ্য যাচাই করার কথা। এই কর্মচারী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। এই নিয়োগের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা নিশ্চয় ভালোভাবে যাচাই করেনি। অথবা নিয়োগের সঙ্গে জড়িত কেউ কোন না কোন উপায়ে এই কর্মচারীকে চাকরি দিয়েছেন। এনবিআরের উচিত হবে প্রথমে এই কর্মচারীকে শুধু চাকরিচ্যুত নয়, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা। একইসঙ্গে নিয়োগের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। অন্য কর অঞ্চলে এই ধরনের ভুয়া সনদে চাকরি যারা নিয়েছেন, তাও তদন্ত করা উচিত।
এই বিষয়ে রাজশাহী কর অঞ্চলের কমিশনার মুন্সী হারুনর রশিদ বিজনেস বার্তাকে বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নেয়ার বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিরাট অপরাধ। কিন্তু চাকরি বিধিতে এই বিষয়ে কিছু বলা না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। চাকরি বিধিতে শুধু যদি অসত্য তথ্য প্রদান-শুধু যদি এ টুকু থাকতো-তাহলে তাকে সাসপেন্ড করা যেতো। আমি এই বিষয়ে নির্দেশনা দিতে এনবিআরে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। নিয়োগ কমিটি যাচাই না করেই চাকরি দিয়েছেন কিনা-এমন প্রশ্নে কমিশনার বলেন, যাচাই করেছে, কিন্তু চাকরি দিয়েছে। আপনি ওই এলাকায় গিয়ে জিজ্ঞেস করলে সবাই বলবেন ওর দাদা না। যারা নিয়োগ দিয়েছেন, তারা জেনেই নিয়োগ দিয়েছেন।

