Header – Before
Header – After

বেতন ৮০ হাজার, সম্পদ হাজার কোটি টাকার

রক্ষক যখন ভক্ষক

কাগজে কলমে তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করা। কিন্তু সেই রক্ষকই যখন ভক্ষকে পরিণত হয়, তখন সে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর দানব। হারুন অর রশীদ তারই জীবন্ত উদাহরণ। চাকরি জীবনে তার মোট আয় ৬ কোটি টাকারও কম, অথচ তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ। পুলিশের ইউনিফর্মের আড়ালে হারুন ছিলেন এক লুটেরা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, যিনি ভয়ভীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা এই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার দেশেই মিলেছে তার বিপুল অবৈধ সম্পদের খোঁজ।

কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া হারুন অর রশীদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চাকরি পান। পরে জানা যায়, তার বাবা ছিলেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। ২০০১ সালে তার পদায়ন আটকে দেয় বিএনপি সরকার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় চাকরি স্থায়ী হয় তার। সর্বশেষ ডিআইজি পদমর্যাদার এই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনারের (ডিবি) সরকারি স্কেল অনুযায়ী বেতন ছিল সাকল্যে ৮০ হাজার টাকার মতো।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও বিপুল সম্পদ রয়েছে হারুন অর রশীদের। এসব সম্পদের মূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি। শুধু উত্তরাতেই তার মালিকানায় রয়েছে দুই ডজনের বেশি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। এসব সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য সেখানে রয়েছে আলাদা অফিস, যা দেখভাল করেন তার কথিত মামা জাহাঙ্গীর আলম। অভিযোগ আছে, জাহাঙ্গীরের নামেও বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন হারুন। এসব সম্পদের বেশিরভাগই জোরপূর্বক দখল বা মালিককে বেকায়দায় ফেলে নেওয়া বলে জানা গেছে। উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরেই তার ছয়টি বাড়ি ও একাধিক মার্কেট রয়েছে।

হারুন অর রশীদ সপরিবারে থাকতেন উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের আটতলা বাড়ির চতুর্থ তলায়। একই রোডে তার আরেকটি ছয়তলা বাড়ি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের ৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১০ কাঠা জমিতে তিনি শ্বশুরের নামে ১০ তলা একটি মার্কেট নির্মাণ করেন। এছাড়া ৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর হোল্ডিংয়ে রয়েছে সাত কাঠার একটি বাণিজ্যিক প্লট এবং ১৫ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে তার ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন। একই সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর প্লটটি তিনি ৩২ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানা যায়। আর রবীন্দ্র সরণির ৭ কাঠার ৪১ নম্বর প্লটটি তিনি মাসিক ১৪ লাখ টাকায় ভাড়া দিয়েছেন।

৫ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর রোডে ২৯ ও ৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১০ কাঠার দুটি প্লট রয়েছে তার। এর একটিতে টিনশেড ঘর এবং অন্যটিতে গুদাম। ১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৫ কাঠার একটি প্লট রয়েছে হারুনের। একই সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় হারুনের ভূমি অফিস। এখানে তার সব সম্পত্তির কাগজপত্র সংরক্ষিত থাকে। ১১ নম্বর সেক্টরের উত্তরা স্মৃতি কেবল টিভি লিমিটেডের পাশে ৫ কাঠার একটি প্লট রয়েছে হারুনের। সেটি ভাড়া দেওয়া হয় স্টার কার সিলেকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। ১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ২১ নম্বরে আছে ছয় তলা বাড়ি। এটি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেন হারুন।

১৩ নম্বর সেক্টরেও আছে হারুনের তিনটি প্লট। শাহ মখদুম এভিনিউয়ে ১২ নম্বর প্লটটিতে তাজ ফুডকোর্টসহ কয়েকটি দোকান ভাড়া দেওয়া হয়। একই সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের প্লটটি ভাড়া দেওয়া। আর ৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর প্লটে হারুনের ছয় তলা ভবন রয়েছে। হারুনের ১৪ নম্বর সেক্টরে আছে দুটি প্লট। ২০ নম্বর রোডের ১৭ ও ১৯ নম্বর প্লট ভাড়া দেওয়া আছে চারটি কোম্পানির শোরুম হিসেবে। ১৩ নম্বর সেক্টর, জমজম টাওয়ারের পাশে, উত্তরা তৃতীয় পর্ব ও পূর্বাচলে কয়েক ডজন ফ্ল্যাট রয়েছে হারুনের- এমন সংবাদও জানা যাচ্ছে। অভিযোগ আছে, বনানী কবরস্থানের পাশে ২০ কাঠার একটি প্লট দখল করে সেটি একটি কোম্পানির কাছে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেন হারুন।

গাজীপুরে তার দায়িত্বকালে অসংখ্য মানুষকে হয়রানির অভিযোগ আছে হারুনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন গ্রুপ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হয়ে জমি দখলে তিনি ভূমিকা রাখেন- এমন অভিযোগ আছে অনেক। এর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জন করেন কোটি কোটি টাকা। কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে শত কোটি টাকার আলোচিত প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের মালিক হারুন অর রশীদ। তার ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার এটি পরিচালনা করেন। ৩০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা বিলাসবহুল এই রিসোর্ট নির্মাণে অনেক মানুষের জমি দখলের অভিযোগ আছে হারুনের বিরুদ্ধে। গাজীপুরে সবুজ পাতা রিসোর্ট এবং গ্রিন টেক নামে দুটি বিলাসবহুল রিসোর্টের শেয়ার রয়েছে হারুনের। আমেরিকান ডেইরি নামে একটি কোম্পানির এমডি হারুনের স্ত্রী, যেখানে মূলত হারুন বিনিয়োগ করেছেন। টঙ্গীর সাতাইশ মৌজায় ৮ বিঘা জমিতে কোনো অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে জেএইচ-জিওটেক্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীর গুশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভিতরে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক হোটেল।

গাজীপুরে ড্রেজার দিয়ে মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, সেই সময় গাজীপুরের পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান বা কামরুল মাউচ্ছা কামরুলের সঙ্গে হারুনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কামরুলের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও পুলিশ সুপারের কাছে ছিল। গাজীপুরে হারুনের মালিকানাধীন রয়েছে সবুজ পাতা রিসোর্ট ও গ্রিন টেক নামে আরও একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট, পাশাপাশি নন্দন পার্কে তার শেয়ার আছে। তিনি আমেরিকান ডেইরি নামের একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন, যার এমডি তার স্ত্রী। ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাবেক এমপি আনিসের সঙ্গে হারুনের ফিশারিজ এবং রেস্টুরেন্টে যৌথ ব্যবসাও রয়েছে। দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবির প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে অভিযোগ জমা হলেও ক্ষমতার দাপটে তিনি সেগুলো তদন্ত করতে দেননি। ৫ আগস্টের পরে দুদক তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে এবং প্রাথমিকভাবে তার দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া যায়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!