Header – Before
Header – After

বায়ুদূষণে প্রতি ঘণ্টায় দেশে দুই শিশুর মৃত্যু

বায়ুদূষণের কারণে ২০২১ সালে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৯ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে—অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছে দুই শিশু। জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি রূপান্তর বিষয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিরো কার্বন অ্যানালিটিকসের (জেডসিএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ‘স্ট্রাকচারাল ডিপেনডেন্সিস পারপেচুয়েট ডিসপ্রোপোরশনেট চাইল্ডহুড হেলথ বার্ডেন ফ্রম এয়ার পলিউশন’ শিরোনামের ওই গবেষণা বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের দুটি প্রধান উৎস হিসেবে গৃহস্থালি ও বাইরের পরিবেশের দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর বড় অংশের জন্য দায়ী করা হয়েছে গৃহস্থালি দূষণকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রান্নার কাজে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৬ হাজার ২৬৪ শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো। এছাড়া, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়াসহ শ্বাসযন্ত্রের রোগে মৃত্যুর ৪০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রেই বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

জানতে চাইলে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক সাজিদ হোসেন খান বলেন, দেশে বায়ুদূষণজনিত রোগ বেড়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বেশ কয়েক বছর ধরে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির হার বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও অ্যাজমা সমস্যা বেড়ে গেছে শিশুদের। যক্ষ্মার প্রবণতাও বাড়ছে। আগে নিয়মিত ব্যবহৃত স্বাভাবিক ওষুধে শিশুর রোগ সেরে যেত। এখন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সারিয়ে তুলতে হচ্ছে।

ঢাকায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ওপর করা ১০ বছরের একটি গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইটভাটা থেকে নির্গত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) শ্বাসতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি তৈরি করেছিল। বিশেষ করে যে দিনগুলোতে বাইরের পরিবেশের বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ছিল ইটভাটা, সেসব দিনে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল।

২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালভিত্তিক একটি গবেষণার ফলাফল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে চার বছরের কম বয়সী শিশুরা আছে। মোট পিএম ২.৫-জনিত শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ২৮ শতাংশই এই বয়সী শিশুরা। যদিও এই বয়সী শিশুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। এই সময়কালে ঢাকার বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। প্রতি ঘন মিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রাম বাড়লে ০-৪ বছর বয়সী শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা (মূলত নিউমোনিয়া ও তীব্র ব্রঙ্কাইটিস) নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে যেত।

শিশুদের ওপর দূষিত বায়ুর গুরুতর কিছু প্রভাব জেডসিএর প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, শিশুরা বিশেষভাবে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকে। কারণ, শিশুকালে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা পুরোপুরি বিকশিত হয়। শরীরের আকারের তুলনায় শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বেশি। সাধারণত তারা মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। মুখের মাধ্যমে শ্বাস নিলে বাতাস কার্যকরভাবে পরিশোধিত হয় না। তা ছাড়া শ্বাস নেওয়া বায়ুর মান দিয়ে শিশুদের বিকাশমান ফুসফুসের আকার ও কার্যক্ষমতা নির্ধারিত হয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বাতাস শ্বাস নেয়, তাদের ফুসফুসের আকার সাধারণত ছোট হয়ে থাকে।

গর্ভকালীন ও শৈশবের শুরুতে দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে এলে আজীবনের জন্য বিকাশজনিত প্রভাব পড়তে পারে বলে জেডসিএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এ সময়টি মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভে থাকা অবস্থায় এবং জন্মের পর শুরুর বছরগুলোতে বায়ুদূষণের সংস্পর্শে আসা শিশুদের আচরণসহ জ্ঞানগত সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে প্রমাণ মিলেছে। বাইরের বায়ুদূষণ মাত্র ২০ শতাংশ কমানো গেলে শিশুর স্মরণশক্তি ৬ শতাংশের বেশি পর্যন্ত বাড়তে পারে।জেডসিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব জন্মের অনেক আগেই শুরু হয়। বায়ুদূষণের সংস্পর্শে আসা অন্তঃসত্ত্বা নারীর অকাল প্রসব হতে পারে। কম ওজনের সন্তান জন্ম হতে পারে।

শিশুদের জীবনের জন্য যত ধরনের ঝুঁকি আছে, তার মধ্যে বায়ুদূষণ দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলে উল্লেখ করা হয় জেডসিএর প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল বায়ুদূষণ। ইটভাটার মতো শিল্প খাতের বায়ুদূষণের পাশাপাশি বাংলাদেশে গৃহস্থালি বায়ুদূষণের হারও খুব বেশি বলে জেডসিএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, রান্নার পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। কাঠ, গোবর ও কয়লার মতো কঠিন জ্বালানি পুড়িয়ে রান্না করার ফলে ঘরের ভেতর ঘন ধোঁয়া তৈরি হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও নবজাতকেরা দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরে কাটানোয় তারা এই দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়। এর ফলে জন্মসংক্রান্ত জটিলতা ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান শাখার পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, রান্নায় উন্নত চুলা প্রচলনে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় যদি সৌরশক্তিচালিত চুলা, এলপিজি বা এলএনজি দেওয়া যায়, বায়ুদূষণ কমে আসবে। সেদিকেই যাওয়ার চেষ্টা চলছে। ২০২৮ সালের দিকে প্রকল্পটি শুরু হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!