Header – Before
Header – After

বখাটে থেকে হয়ে গেলেন স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে এবং তাদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় রংপুরের মোতাজ্জিরুল ইসলাম মিঠু স্বাস্থ্য খাতের স্বঘোষিত ‘মাফিয়া ডন’ হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি ঢাকা, রংপুরসহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য ফ্ল্যাট, আলিশান বাড়ি ও জমিসহ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেন। তিন বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযোগ পুনরায় দেখা হলে, বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সংস্থাটি মামলা করলে পরের দিন বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) মিঠুকে ঢাকার গুলশান থেকে গ্রেফতার করা হয়।

মিঠুর উত্থান যেভাবে

রংপুরের এক সময়ের বখাটে হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জিরুল ইসলাম মিঠুর বাড়ি গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে। ধাপ মেডিক্যালের পূর্ব গেট এলাকায় তাদের পৈত্রিক টিনশেড আধাপাকা বাড়ি ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ ছিল না। হঠাৎ এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সহযোগিতায় তিনি রংপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ শুরু করেন এবং তার উত্থান ঘটে। তখন তার ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য।

এরপর তিনি আর পেছনে তাকাননি। এক পর্যায়ে সারা দেশের বেশিরভাগ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে পরিচিত হন। একচেটিয়াভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। তার দাপটে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বড় কর্মকর্তারা জিম্মি হয়ে যান। স্বাস্থ্য বিভাগের বড় কর্তা যোগ দিলেই ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ব্রিফকেস তার বাসায় পৌঁছে যেত। এমন অবস্থায় দেশের বড় বড় কর্মকর্তারা হেলিকপ্টারে সফরসঙ্গী হয়ে রংপুরে আসতেন মিঠুর কাছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য বিভাগের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে মিঠু বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি অতিউচ্চ মূল্যে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী মালামাল না সরবরাহ করা, অনেক ক্ষেত্রে মালামাল সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন এবং অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত মালামাল বিতরণের মতো কর্মকাণ্ড চালাতেন। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, আইএইচটি সিলেট, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল, সিএমএসডিসহ বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি মালামাল সরবরাহের নামে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।

দুদকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিঠু অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এবং বিদেশে—যেমন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর—হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে এটি প্রমাণিত হওয়ায়, দুদক দেশের মধ্যে ঢাকা, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তার ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৮ টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে।

২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর তৎকালীন দুদকের সহকারী পরিচালক মশিউর রহমানের লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানের মালিক মিঠুর মালিকানাধীন রংপুরসহ সারা দেশে ৪১টি সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালতে আবেদন করেন। তৎকালীন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আসাদুজ্জামান সব সম্পদ জব্দের আদেশ দেন। যার পারমিশন পিটিশন নম্বর ৪৩৬/২০২৩।

রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে প্লট, ফ্লাট, রংপুরে বিলাসবহুল বাড়িসহ ৪১টি সম্পদ জব্দ করার আদেশ দেওয়া হয়। আদেশনামায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা রেজিস্ট্রার, মহাপরিদর্শক আইজিআরসহ সবাইকে আদেশ দেন, কোনোভাবেই যেন মিঠু নামীয় এসব সম্পদ হস্তান্তর করতে না পারে। সেই সঙ্গে ৪১টি সম্পদ যে জব্দ করা হয়েছে তার তালিকা সংবলিত একটি বিজ্ঞপ্তি দুর্নীতি দমন কমিশনকে তাদের নিজ ব্যয়ে বহুল প্রচারিত একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রচারের নির্দেশও দেওয়া হয়।

এদিকে ২০২৩ সালেই মোতাজ্জিরুল ইসলাম মিঠুর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারিরও আদেশ দেন আদালত। সেই অনুযায়ী পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) এবং দুদকের অনুসন্ধানকারী টিমের দল নেতা মশিয়ার রহমানকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন করে আদেশ নেওয়া ছাড়া সম্পদ জব্দে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি মিঠুর জন্মস্থান রংপুরে কমপক্ষে ৩০টির মতো সম্পদের একটিও জব্দ করা হয়নি। দুদকের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ না নেওয়ায় রংপুর মহানগরীর অভিজাত এলাকায় অবস্থিত ১০তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক কছির উদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সাইনবোর্ড লাগিয়ে সেখানে হাসপাতাল চালু রাখা হয়েছে।

দুদকের পক্ষ থেকে এতবড় প্রতিষ্ঠান জব্দ করার কোনও আবেদন পর্যন্ত করা হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক, সচিবসহ দেশের বড় বড় হাসপাতালের পরিচালকের নিয়োগ বদলি সব নিয়ন্ত্রণ করতো মিঠু। তবে ২০২২ সালের দিকে মিঠুর একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল সোচ্চার হলে ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হলেও নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম বাদ দিয়ে বেনামে তার ঠিকাদারি আর দালালি চলতে থাকে।

** স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মিঠু আটক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!