Header – Before
Header – After

‘ফ্রেশ সুগারের’ বন্ড সুবিধার অপব্যবহার

মেঘনা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান

দেশের বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। ইউনাইটেড সুগার মিলস লিমিটেড এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানির পর পরিশোধন করে ‘ফ্রেশ সুগার’ নামে প্যাকেটজাত ও বাজারজাত করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামালের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ থেকে অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ করে আসছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটির বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে।

এতে দেখা যায়, প্রায় ১০ কোটি টাকার কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের জন্য মজুদ করে রাখা হয়েছে, যার প্রমাণ পেয়েছে বন্ড কমিশনারেট। এর মধ্যে শুল্ককর প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সম্প্রতি বন্ড কমিশনার শুনানি শেষে জরিমানার আদেশ দিয়ে এ শুল্ককর পরিশোধে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৫ দিনের সময় দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কয়েক দফা কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি। পরে গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিজনেস বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিতে হবে।’ তবে ইউনাইটেড সুগার মিলস লিমিটেডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে বলেন, ‘বন্ড কমিশনারেট অযৌক্তিকভাবে শুল্ককর দাবি করছে। রায় হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ট্রাইব্যুনালে বা প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাব।’

এনবিআর সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও মেঘনাঘাটে অবস্থিত ইউনাইটেড সুগার মিলস লিমিটেড ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শিল্প বিকাশে প্রণোদনা প্রদানের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালে ইউনাইটেড সুগারকে বন্ড লাইসেন্স দেওয়া হয়। বন্ড সুবিধায় প্রতিষ্ঠানটি একসঙ্গে কাঁচামাল এনে বন্ড কমিশনারেটের তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে তা পরিশোধন করবে। তবে শর্ত থাকে শুল্ককর পরিশোধ করে নির্দিষ্ট সময় পর এসব কাঁচামাল ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ করছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বন্ড কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে।

পরিদর্শনে বন্ডেড ওয়্যারহাউজে বন্ড রেজিস্টার অপেক্ষা দুই হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন কাঁচামাল বেশি পাওয়া যায়। শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে অপসারণের জন্য এসব কাঁচামাল মজুদ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব কাঁচামালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, যার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় চার কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রিভেন্টিভ টিম এ নিয়ে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে একইভাবে কাঁচামাল অপসারণ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার সুপারিশ করা হয়। শুল্ককর পরিশোধ ও কাঁচামাল মজুদ বিষয়ে বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়।

২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লিখিত জবাবে বলা হয়, প্রিভেন্টিভ টিম পরিদর্শনের সময় কাঁচামাল পিরামিড আকারে থাকায় সঠিকভাবে পরিমাপ না করে অনুমান করে দুই হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন বেশি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে ছয়টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১৪ হাজার ৫৭৭ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। একই বছরের ১ ডিসেম্বর এক্স-বন্ড বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে প্রায় ১৯ কোটি টাকার শুল্ককর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। ৮ ডিসেম্বর বন্ড কমিশনারেট থেকে ছাড়পত্র (রিলিজ অর্ডার) নিয়ে কাঁচামাল অপসারণ শুরু হয়। এর মধ্যে প্রিভেন্টিভ টিম বন্ডেড ওয়্যারহাউজ পরিদর্শন করে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা দাবি করেন, পরিদর্শনের সময় অবৈধভাবে অপসারণের জন্য যে দুই হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন চিনি মজুদ রয়েছে, কিন্তু বন্ড রেজিস্টারে উল্লেখ নেই বলে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সঠিক নয়। মজুদ করা কাঁচামাল এক্স-বন্ডের মাধ্যমে ছাড় নেওয়া। এ প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে অপসারণের জন্য কখনও কাঁচামাল মজুদ করে না। শুনানিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা একই দাবি করেন। মজুদ কাঁচামাল আর বন্ড রেজিস্টার আড়াআড়িভাবে যাচাই করলে অতিরিক্ত মজুদ পাওয়া যাবে না বলেও দাবি করা হয়।

কিন্তু প্রিভেন্টিভ টিমের কর্মকর্তারা যাচাই করে দেখতে পান, প্রতিষ্ঠানটির দাবি যৌক্তিক নয়। প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিতে অবৈধভাবে কাঁচামাল মজুদ করেছে বলে প্রমাণিত হয়। শুনানি শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা (অর্থদণ্ড) করে বন্ড কমিশনার আদেশ জারি করেন। এ জরিমানা প্রযোজ্য শুল্ককরের অতিরিক্ত হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। শুল্ককর ও জরিমানার অর্থ পরিশোধে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি একই কায়দায় বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছে কি না সেজন্য প্রতিষ্ঠানের বন্ডিং কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ইউনাইটেড সুগার মিলে দৈনিক দুই হাজার ৫০০ মেট্রিক টন থেকে বছরে সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন চিনি পরিশোধন করা হয়। পরে ‘ফ্রেশ সুগার’ ব্র্যান্ডে প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করা হয়। ফ্রেশ সুগার স্থানীয় চাহিদার ২১ শতাংশ পূরণ করে। ইউনাইটেড সুগার মিলস লিমিটেড ছাড়াও মেঘনা গ্রুপের রাসায়নিক, সিমেন্ট, ভোক্তা পণ্য, আবাসন, বিমা, সিকিউরিটিজ ও ইউটিলিটি খাতের ৩৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!