** প্রায় ৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার ছয় ধরনের কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ
** অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাড়ে তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে
** প্রতিষ্ঠানের দাবি-অপসারণ নয়, কাঁচামালের অনুমোদন আর ব্যবহারের তফাৎ রয়েছে
দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হবিগঞ্জ টেক্সটাইলস লিমিটেড। শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিভিন্ন কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সিলেট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মামলা পর্যালোচনা শেষে সম্প্রতি অর্থদণ্ডের আদেশ দেন। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়নি। কাঁচামাল ব্যবহার ও অনুমোদনের মধ্যে তফাৎ ছিল। কাস্টমস সেই পার্থক্যকে অবৈধভাবে অপসারণ বলছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জ টেক্সটাইল লিমিটেড হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের শাহজীবাজার অলিপুরে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অবস্থিত। ২০১৪ সালে কারখানাটি উৎপাদন শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি লিঙ্গারি, আন্ডারওয়্যার, ইনডোর ক্লথিং পণ্য উৎপাদন করে। এটি শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সালে এ প্রতিষ্ঠানকে বন্ড লাইসেন্স দেওয়া হয়।
সূত্র আরও জানায়, হবিগঞ্জ টেক্সটাইলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি তদন্ত করতে এনবিআর সিলেট ভ্যাট কমিশনারেটকে নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের ১২ জুলাই সিলেট ভ্যাট কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন করেন। প্রিভেন্টিভ টিম এসময় বন্ডেড ওয়্যারহাউজে বন্ড রেজিস্টার অপেক্ষা এন্টিক্রেজিং এজেন্ট ১০ হাজার ৮৩৯ কেজি, লেভেলিং এজেন্ট ৭ হাজার ৭৮৫ দশমিক ৩২ কেজি, ফিক্সিং এজেন্ট ১৫ হাজার ১০৩ কেজি, ফিনিশিং এজেন্ট এক লাখ ৭৩ হাজার ৪৩৭ কেজি, ডিটারজেন্ট ১৩ হাজার ৯৬৪ কেজি ও এনজাইম ৫৯ হাজার ৮১৭ কেজি কাঁচামাল কম পায়। এসব কাঁচামালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৫ কোটি ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫৩৩ টাকা। এর উপর প্রযোজ্য শুল্ককর এক কোটি ৭৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩৯ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এসব কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে ধারণা করেন প্রিভেন্টিভ টিম, যা কাস্টমস আইন, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সিং বিধিমালা অনুযায়ী দণ্ডনীয়।
সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানকে একইবছরের ৩০ জুলাই দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে সিলেট ভ্যাট কমিশনারেট। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১৭ জুলাই লিখিত জবাবে বলা হয়, যেসব কাঁচামাল কম পাওয়া গেছে তার মধ্যে প্রকৃত কমপ্রাপ্ত কাঁচামাল দুইটি হলো সফটটেনিং এজেন্ট বা ফিনিশিং এজেন্ট এবং এনজাইম। পণ্য উৎপাদনে কাঁচামালের ব্যবহার ও ডেডো কর্তৃক একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি জারি করা সহগের সাথে এ দপ্তর (ভ্যাট সিলেট) থেকে অনুমোদিত ইউপিসমূহে কাঁচামাল ব্যবহারের পরিমাণের তারতম্য থাকায় দুইটি কাঁচামালের ঘাটতি পেয়েছে প্রিভেন্টিভ টিম। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত শুনানির আবেদন করা হয়। দুই দফায় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত শুনানিতে ডাকা হয়। একাধিকবার দেওয়া হয় চিঠি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোন কর্মকর্তা ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নেয়নি।
সূত্র আরও জানায়, শুনানিতে অংশ না নেওয়ায় প্রতিষ্ঠানের দেওয়া নোটিসের জবাব, প্রিভেন্টিভ টিমের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন সিলেট ভ্যাট কমিশনার (তৎকালীন) হোসাইন আহমেদ। পর্যালোচনা শেষে ৯ নভেম্বর কমিশনার আদেশ দেয়। যাতে বলা হয়, শুনানিতে অংশ না নেওয়ায় প্রতিষ্ঠানের নোটিসের জবাব, প্রিভেন্টিভ টিমের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের উপর প্রযোজ্য শুল্ক-করাদি আদায়যোগ্য এবং অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তা দন্ডযোগ্য। প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। অর্থদণ্ড ও প্রযোজ্য শুল্ককরসহ মোট ৫ কোটি ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ১১৮ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে প্রতিষ্ঠানকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। অন্যথায় ১৮ নভেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত ও বিন লক করা হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র জানায়, সিলেট ভ্যাট কমিশনারেরের আদেশের পর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে টাকা জমা দেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়। তবে আপীলাত ট্রাইব্যুনাল সিলেট ভ্যাট কমিশনারেটের দাবি করা শুল্ককর ও অর্থদণ্ডের ২ শতাংশ নগদ ট্রেজারি চালান ও ৩ শতাংশ নি:শর্ত ব্যাংক গ্যারান্টি সরকারি কোষাগারে ১৪ জানুয়ারির মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরীর ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা দেওয়া হলেও জবাব দেননি। এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপনন) কামরুজ্জামান কামাল বিজনেস বার্তাকে বলেন, কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি বা অবৈধভাবে অপসারণ করা হয়নি। আমরা যেসব পণ্য তৈরি করি তাতে আড়াই কেজি কাঁচামাল ব্যবহার করতে হয়, না হয় এসব পণ্য সফট হয় না। কিন্তু প্রথম থেকেই আমাদের এক কেজির অনুমোদন দিয়ে আসছে ভ্যাট কমিশনারেট। এক কেজি দিয়ে পণ্য তৈরি করা যায় না। আমরা আড়াই কেজি অনুমোদনের জন্য প্রথম থেকেই আবেদন করে আসছি। সেজন্য র্দীঘদিন থেকে বন্ড রেজিস্টারে কাঁচামালের তারতম্য পেয়েছে কমিশনারেট। অবশ্য ইতোমধ্যে আমাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভ্যাট কমিশনারেটের আদেশের আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আমরা আবেদন করেছি।

