পাচার ও পুঁজিবাজার কারসাজির ‘মাস্টার’ আদনান

মানি মার্কেট ও শেয়ারবাজারে সমানভাবে সমালোচিত। ব্যাংক লুটপাট, ঋণ খেলাপ, কমিশন বাণিজ্য, মানি লন্ডারিং ও শেয়ারবাজার কারসাজির অন্যতম কারিগর তিনি। এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আদনান ইমাম। একাধিক সহযোগী নিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত আদনান বেসরকারি এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির (ইসি) চেয়ারম্যান। একইসঙ্গে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গিলবার্ট স্ট্রিট এস্টেটস লিমিটেডের পরিচালক তিনি। শেখ হাসিনা সরকারের বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং ঋণখেলাপির হোতা (বর্তমানে আটক) সালমান এফ রহমানের উত্তরসূরি তিনি।

ব্যাংকের ঋণ সুবিধায় রপ্তানি করলেও রপ্তানির অর্থ দেশে আনতেন না এবং ঋণ পরিশোধও করতেন না। চতুর আদনান ইমাম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দখল করা প্রায় ১৫টি কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচার করতেন। একইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সখ্য রেখে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ পাইয়ে দেওয়া এবং সেই ঋণের বিপরীতে কমিশন নেওয়ায় দক্ষ আদনান। আওয়ামী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শেয়ারবাজারে গত কয়েক বছরে সালমান এফ রহমানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যেসব ব্যক্তি বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। কারসাজির টাকায় আদনান ইমাম দুবাইয়ে করেছেন প্রাসাদ, লন্ডন ও কানাডায় রয়েছে বাড়ি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আগেই ব্যাংক হিসাব ফাঁকা করে ফেলেন তিনি।

দেশে আনেননি রপ্তানির টাকা

এনআরবিসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার ছয়জন গ্রাহকের অন্তত ৩৪ কোটি ৪১ লাখ টাকার রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আসেনি। তার মধ্যে পাঁচটি কোম্পানি ৯০ কোটি টাকার এলসির বিপরীতে কোনো ধরনের রপ্তানি করেনি। ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তরা শাখা গত চার বছরে এই অর্থ এনআরবিসি ব্যাংক ফোর্সড লোন হিসাবে দেখায়। তথ্য আড়াল করে বিপুল পরিমাণ টাকা সাধারণ ঋণে রূপান্তরিত করা হয় এবং বারবার পুনঃতফশিল করা হয়েছে। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও মামলার নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। রপ্তানির অর্থ না আসার পরও রপ্তানি নথি জমা না দিয়েই অর্থ তুলে নেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটির সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত আছেন ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম। পাচারের ঘটনায় গত বছরের ১১ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যাংকটির ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অভিযোগ করা হয়েছে, প্রতারণামূলকভাবে তারা ব্যাংক থেকে ৭৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ছয়টি কোম্পানির মধ্যে একটি হচ্ছে ইক্সোরা অ্যাপারেলস।

কোম্পানি দখল যখন নেশা

শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আদনান ইমাম দখলকে ‘নেশায়’ পরিণত করেন। ইক্সোরা অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের একটি রপ্তানিমুখী সোয়েটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দখল করেন তিনি। এ ছাড়াও পলিগন ফ্যাশন, রিল্যাক্স ফ্যাশন, ইনসাইড নিট কম্পোজিট, সাফি নিট, ফাইভ এফ অ্যাপারেলস, ব্লেসিংস নিটওয়্যার ও সিলভার অ্যাপারেলসসহ প্রায় ১৫টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তিনি দখল করেন। এগুলোর মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার অবৈধ ঋণ অনুমোদন, ঋণ জালিয়াতি এবং এর আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দুদকের তদন্ত অনুসারে, ইক্সোরা অ্যাপারেলস ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকার পোশাকের ১২টি চালান যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয় দেশে আনেনি। ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন থেকে তৈরি করা নথি অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকটির বৃহত্তম ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ইক্সোরা ১৯তম। ইক্সোরা অ্যাপারেলস সোয়েটার ফ্যাক্টরির নাম ব্যবহার করে পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পাচার করা হয়েছে। রপ্তানির অর্থ না আসার পরও রপ্তানি নথি জমা না দিয়েই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়। পরে সাধারণ ঋণ হিসাবে দেখানো হলেও তা পরিশোধ করা হয়নি।

এনআরবিসি ব্যাংকের ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ডিভিশনের (আইসিসিডি) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পলিগন ফ্যাশন লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯২৮ মার্কিন ডলার বা ৯ কোটি ১০ লাখ টাকার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি। ২০২৩ সালে এনআরবিসি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতা হচ্ছে পলিগন ফ্যাশন। দখলে নেওয়া পলিগনের মোট বকেয়া ঋণ গত নভেম্বরে দাঁড়িয়েছিল ৮৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। টাকা আদায়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়েছে। ২০২১ সালের আইসিসিডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যাংকটির ২০তম বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা ছিল ব্লেসিং নিটওয়্যার লিমিটেড। কোম্পানিটির ছয় লাখ ৬১ হাজার ৮৫ ডলার (সাত কোটি ২০ লাখ টাকা) মূল্যের রপ্তানি আয় ব্যাংকে জমা করা হয়নি। আরও কয়েকটি এলসির বিপরীতে চালান করতে না পারায় ব্যাংককে আরও দুই দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার (২৫ কোটি টাকা) পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি। ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর এসব ঋণকে সাধারণ ঋণে পরিণত করা হয়। রপ্তানির তিন লাখ এক হাজার ১৯১ ডলার বা তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা ফেরত না দিয়ে ফোর্সড লোনে পরিণত করেছে। কোম্পানিটির ছয় লাখ ৬১ হাজার ৮৫ ডলার (সাত কোটি ২০ লাখ টাকা) মূল্যের রপ্তানি আয় ব্যাংকে জমা করা হয়নি। আরও কয়েকটি এলসির বিপরীতে চালান করতে না পারায় ব্যাংককে আরও দুই দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার (২৫ কোটি টাকা) পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি। ২০২১ সালে কোম্পানিটির ৮৩ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ভাইব্রানিয়াম নামে আরেকটি কোম্পানি। ভাইব্রানিয়ামের নিবন্ধন নথি অনুযায়ী, এর চেয়ারম্যান বদরুল হাসান পাটোয়ারী। তিনি জেনেক্স ইনফোসিস নামে একটি কোম্পানির সেক্রেটারি। সেই জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান আদনান ইমাম। দুদকের মামলায় বদরুল হাসান পাটোয়ারীকে আসামি করা হয়নি। এভাবেই চতুর আদনান ইমাম বিদেশে ডলারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন।

যুক্তরাজ্যেও বিস্তৃত ব্যবসা

দেশের বাইরে যুক্তরাজ্যের রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গিলবার্ট স্ট্রিট এস্টেটস লিমিটেডের পরিচালক তিনি। তার পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে একটি আদনানের স্ত্রী যৌথভাবে মালিকানাধীন। এই রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মূল্য ১০.৫২ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৫ কোটি টাকার বেশি। মালিকানাধীন বা সরাসরি সংযুক্ত ছয়টি কোম্পানিতে কমপক্ষে ১,৫১৬ কোটি টাকা ইউসিবি থেকে ঋণ সুবিধা নিয়েছেন তিনি। ব্যাংকে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন আর সিন্ডিকেট বসিয়ে অনিয়ম ও লুটপাট করলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। পাচারের টাকায় লন্ডনে বিলাসি জীবনযাপন এবং ব্যবসা করছেন।

অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি আদনান ইমামের। তাকে এ বিষয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, তিনি (আদনান ইমাম) পালিয়ে এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!