Header – Before
Header – After

ইউরোপে যাচ্ছে পাখির বাসা, বিড়াল-কুকুরের ঘর

নারকেলের ছোবড়া, কাপড়ের টুকরা, তুলা ও সুতা—দেখতে সাধারণ এসব উপকরণ দিয়েই বাগেরহাটের নারীরা তৈরি করছেন দৃষ্টিনন্দন নানা পণ্য। তাঁদের তৈরি পাখির বাসা, পোষা প্রাণীর ঘর, খেলনা, স্লিপার, ফুলের টব ও সফট টয় এখন শুধু দেশেই নয়, রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের বাজারে। বেলজিয়াম, জার্মানি ও গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এসব পণ্য, যা স্থানীয় নারীদের জীবিকায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

স্থানীয় উদ্যোক্তা রোজী আহমেদের গড়া কারখানা ‘মার্সাস অর্গানিক প্রোডাক্ট’ এখন রপ্তানির পাশাপাশি নারী কর্মসংস্থানের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে। বাগেরহাট শহরের বাসাবাটি এলাকায় নিজ বাড়িতে গড়ে তোলা এই কারখানাটিতে এখন প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন নারী কাজ করছেন। তাদের মধ্যে কেউ গৃহবধূ, কেউ কলেজপড়ুয়া। কেউ নারকেলের ছোবড়া কেটে ছাঁচ বানাচ্ছেন, কেউ কাপড় সেলাই করছেন কেউবা খেলনার ভেতর তুলা ভরছেন। নিপুণ হাতে তারা পণ্যগুলো তৈরি করছেন পরিপূর্ণ রপ্তানিযোগ্য রূপে।

সরেজমিনে দেখা যায়, তিনতলা ভবনের নিচতলা, পাশের একতলা ভবন ও একটি টিনশেড ঘরে একসঙ্গে চলছে বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজ। সেখানে ২৫ থেকে ৩০ জন নারী কর্মী ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ভবনের তৃতীয় তলায় তৈরি হচ্ছে পাখির বাসা, আর একতলা ভবনে স্লিপারসহ অন্যান্য পণ্য। কাটিং, সেলাই, রং করা, গুছানো ও প্যাকিং—প্রতিটি ধাপেই দক্ষতার ছোঁয়া দিচ্ছেন নারীরা। তাঁদের হাতে তৈরি এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে জেনে প্রত্যেকের চোখেমুখে ফুটে ওঠে গর্ব আর আনন্দের ঝিলিক।

রোজী আহমেদ জানান, ২০১৯ সালে প্রথম তিনি নারকেলের ছোবড়া দিয়ে কোকোপোল, মালচিং ম্যাট, হ্যাংগ্রিড বাস্কেট ও ফুলের টব তৈরি করে দেশে বিক্রি শুরু করেন। ২০২০ সালের করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন নারীদের কথা ভেবে তিনি বাড়িতেই পণ্য তৈরির উদ্যোগ নেন। শুরু করেন মাত্র ১০ থেকে ১২ জন নারীকে নিয়ে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দিয়েই তৈরি করাতে থাকেন পাখির বাসাসহ নানা সামগ্রী। একপর্যায়ে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে আসে ১ হাজার পিস পাখির বাসা তৈরির অর্ডার। তিনি নিজেই একটি নতুন মডেল তৈরি করেন, যা অর্ডারদাতার পছন্দ হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে উৎপাদনের পরিধি বাড়তে থাকে। প্রশিক্ষিত নারী কর্মীদের সংখ্যা বাড়ে, তৈরি হতে থাকে একের পর এক নতুন পণ্য।

রোজী জানান, তার কারখানায় বর্তমানে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে ১৩ ধরনের পাখির বাসা, ফুলের বাস্কেট, কোকোপোল (লতাজাতীয় গাছের জন্য কাঠি), থালা-বাসন মাজার ঝুড়ি, বিড়ালের ঘর, দোলনা, ব্যাগ, খেলনা, চার ধরনের বিছানা, ড্রেজ, কুকুরের খেলনা, কাপড় আর ছোবড়া দিয়ে তৈরি স্লিপার, মালচিং ম্যাট, উইন্টার শিট, কাঠের টুল, বেবি ভাউচারসহ প্রায় ৪০ ধরনের পণ্য। উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণও পরিবেশবান্ধব। তিনি জানান, এসব পণ্যের প্রথম চালান ২০২২ সালে বায়ারের মাধ্যমে বেলজিয়ামে পাঠানো হয়। ২০২৩ সালে সফট টয়, স্লিপার, হেয়ার ব্যান্ড ও কুকুর-বিড়ালের খেলনা রপ্তানি হয় গ্রিসে। এরপর ২০২৪ সালে জার্মানিতে পাঠানো হয় ২ হাজার পিস পাখির বাসা। চলতি বছরের মে মাসে গ্রিসে গেছে ১১ হাজার জোড়া স্লিপার। গ্রিসের আরও একটি অর্ডারের জন্য বর্তমানে চলছে ৬০ হাজার জোড়া স্লিপার তৈরির কাজ।

ইতোমধ্যে চারটি দেশে প্রায় কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে বলে জানান রোজী আহমেদ। দেশীয় বাজারসহ তার কারখানার মোট বিক্রি পৌঁছেছে প্রায় ৫ কোটি টাকায়। রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাঁচামাল। রোজী বলেন, নারকেলের ছোবড়া এখন সহজলভ্য নয়। আগে বাগেরহাটে প্রচুর নারকেল থাকলেও বর্তমানে উৎপাদন কমে গেছে, তাই পাশের দেশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। রোজী আহমেদের পরিকল্পনা রয়েছে কারখানাটি ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে সম্প্রসারণ করার। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তা পেলে তিনি এটি বাস্তবায়ন করতে চান। কারখানা বড় হলে আরও নারীর কর্মসংস্থান হবে এবং উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে দেশও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে।

উদ্যোক্তা রোজীর এই সফলতায় তার পরিবারেরও রয়েছে বড় অবদান। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। তাদের যৌথ পরিবারের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে কাঠ দিয়ে পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরি করা হচ্ছে। সেই ঘরের বেড়া, জানালা, দরজা এমনকি ছাদও কাঠের। এসব কাঠের ঘরও রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপে।

এই কারখানায় কর্মরত অন্তি ঘোষ, বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের অনার্সের ছাত্রী। পড়ালেখার পাশাপাশি পাখির বাসা তৈরির কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কাজ করে গড়ে ৪০০ টাকা পাই। এই টাকা পড়াশোনা ও সংসারে খরচ হয়।’ স্লিপার তৈরিতে যুক্ত জেনি আক্তার জানান, প্রতিদিন ২০০ জোড়া সোলের ওপর মেশিনে ভ্যাম্প সেলাই করে জোড়া লাগান তিনি। তার দৈনিক আয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এই আয়ে তাদের সংসার চলে ভালোভাবেই।

বাগেরহাট বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মো. শরীফ সরদার বলেন, ‘রোজী আহমেদ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তার কারখানার পণ্য এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় নারীদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!