চট্টগ্রাম বন্দরের চারপাশে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ব্যবস্থাপনার ব্যবসা সম্প্রসারণ লাভ করছে। বেসরকারি খাতে ১৯টি ডিপো থাকলেও মোট ব্যবসার সিংহভাগই পরিচালনা করছে মাত্র ছয়টি ডিপো। নতুনভাবে বেসরকারি ডিপোগুলোর সেবা মাশুল বৃদ্ধি পায়, যা তাদের আয়ও বাড়িয়ে দেবে। কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ১৯টি বেসরকারি ডিপো মিলিয়ে ৮ লাখ ৩০ হাজার একক কনটেইনার ব্যবস্থাপনা করেছে, যা গত বছরের একই সময়ে ৭ লাখ ৮ হাজার একক কনটেইনারের তুলনায় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি।
বেসরকারি ডিপোগুলো মূলত নিয়ন্ত্রিত সেবাশিল্প হিসেবে কাজ করে। কারখানা থেকে রপ্তানি পণ্য ডিপোগুলোতে আনা হয় এবং সেগুলো কনটেইনারে বোঝাই করা হয়। এরপর শুল্কায়ন সম্পন্ন করে ডিপো থেকে বন্দরে পাঠানো হয় এবং জাহাজে ওঠানো হয়। বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হওয়া কনটেইনারের প্রায় ৯০ শতাংশই ডিপোতে ব্যবস্থাপনা করা হয়, এবং এই সেবার বিনিময়ে ডিপোগুলো মাশুল আদায় করে। একইভাবে, ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য বন্দরে জাহাজ থেকে নামানোর পর ডিপোতে নিয়ে খালাস করা হয়, যার বিনিময়েও মাশুল নেওয়া হয়। এছাড়া খালি কনটেইনার সংরক্ষণ করেও ডিপোগুলো ভাড়া আয় করে।
গত ১ সেপ্টেম্বর ডিপো অ্যাসোসিয়েশন রপ্তানি খাতের সাত ধরনের সেবার মাশুল বাড়িয়েছে। রপ্তানির প্রধান খাত কনটেইনারে পণ্য বোঝাই করে বন্দর দিয়ে রপ্তানির মাশুল একলাফে ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া খালি কনটেইনারের ভাড়াও বাড়িয়েছে ডিপোগুলো। এসব খাতে সেবার মাশুল বাড়ানোর কারণে ডিপোগুলোর বার্ষিক আয় আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
পাঁচ ডিপোর নিয়ন্ত্রণে ৫৯% ব্যবসা
কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসের তথ্য অনুযায়ী, সর্বাধিক ব্যবসা করেছে সীতাকুণ্ডে অবস্থিত কেডিএস গ্রুপের কেডিএস লজিস্টিকস। প্রতিষ্ঠানটি আমদানি ও রপ্তানি মিলিয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার একক কনটেইনার ব্যবস্থাপনা করেছে এবং সব ডিপোর মধ্যে মোট কনটেইনার ব্যবস্থাপনার ১৫ শতাংশ একাই নিয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে অবস্থিত এমজিএইচ ও এবিসি গ্রুপের যৌথ উদ্যোগ পোর্টলিংক লজিস্টিকস সেন্টার, যারা চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ১ লাখ ১৬ হাজার একক কনটেইনার পরিচালনা করেছে এবং বাজারের ১৪ শতাংশ অংশ দখল করেছে।
জানতে চাইলে এমজিএইচ গ্রুপের লাইনার শিপিং বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ইকবাল আলী বলেন, রপ্তানি ও আমদানি বাড়ায় ডিপোগুলোতে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার হার বাড়ছে। তবে ডিপোর মাশুল বাড়ানো হলেও নিয়মিত গ্রাহকদের কাছ থেকে চুক্তি শেষ হওয়ার আগে মাশুল বাড়ানোর সুযোগ নেই। সে অর্থে মাশুল বাড়ানোর প্রভাব খুব দ্রুত পড়বে না। তবে ডিপো পরিচালনার খরচ বাড়তে থাকায় তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল–ইস্ট–ওয়েস্ট)। সামিট গ্রুপ ও অ্যালায়েন্স হোল্ডিংসের যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৯২,৬৭০ একক কনটেইনার ব্যবস্থাপনা করেছে এবং এর বাজার অংশ ১১ শতাংশ। এছাড়া এই গ্রুপের আরও একটি যৌথ মালিকানাধীন ডিপো রয়েছে, এসএপিএল (নর্থ), যা একই সময়ে ৩৩,৭০১ একক কনটেইনার পরিচালনা করেছে। চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে নগরের কাট্টলীতে অবস্থিত ইস্পাহানি-সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনাল, যা চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৮০,১২৯ একক কনটেইনার ব্যবস্থাপনা করেছে। এই টার্মিনাল ইস্পাহানি গ্রুপ ও সামিট ও অ্যালায়েন্স হোল্ডিংসের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত।
জানতে চাইলে এসএপিএলের পরিচালক কামরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, রপ্তানি বাড়ছে। আবার বন্দর থেকে আমদানি কনটেইনার খালাসের কার্যক্রম ধাপে ধাপে ডিপোতে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে ডিপোতে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার হার বাড়ছে। মাশুল বাড়ানো নিয়ে তিনি বলেন, ২০১৬ সালের পর রপ্তানি কনটেইনার ব্যবস্থাপনার মাশুল বাড়ানো হয়নি। শুধু ২০২২ সালে কয়েকটি খাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় করা হয়েছিল। বরং ডিপোগুলো আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের (শিপিং এজেন্ট, বিদেশি ক্রেতা) কমপ্লায়েন্স (কর্মসহায়ক পরিবেশ) মানার জন্য বিপুল বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে পরিচালন খরচ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে মাশুল বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ব্যবসার দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে ছিল পতেঙ্গায় অবস্থিত ইনকনট্রেড। তারা ব্যবস্থাপনা করেছে ৭৮ হাজার একক কনটেইনার। ডিপোর মোট ব্যবসার ৫৯ শতাংশ অংশীদারি ছিল এই পাঁচ ডিপোর।
কনটেইনার ডিপো সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে দেশে প্রথম বেসরকারি ডিপো ‘সি ফেয়ারাস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে যুক্ত হয় ওশান কনটেইনার। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মূলত খালি কনটেইনার ব্যবস্থাপনা করত ডিপোগুলো। ১৯৯৯ সাল থেকে তাদের প্রথমবারের মতো রপ্তানি কনটেইনার ব্যবস্থাপনার অনুমতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০০৭ সাল থেকে রপ্তানির পাশাপাশি নির্ধারিত আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরের পরিবর্তে ডিপোতে নিয়ে খালাসের অনুমতি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১ থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরত্বে এসব ডিপোর অবস্থান।
ইস্পাহানি-সামিট অ্যালায়েন্স এগিয়ে
ডিপোর ব্যবসা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে ইস্পাহানি-সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনালের। ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের কাট্টলীতে ভিক্টোরি জুট মিলের জায়গায় যাত্রা শুরু করে ইস্পাহানি-সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনাল নামের এই ডিপো। তবে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৯ সালের অক্টোবরে। চালুর পর থেকে প্রতিবছর ব্যবসায় তাদের দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কনটেইনার ব্যবস্থাপনার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ শতাংশ। এদিকে প্রবৃদ্ধির হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পতেঙ্গায় অবস্থিত ইস্টার্ন লজিস্টিকস ডিপো। কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩১ শতাংশ। এরপর প্রবৃদ্ধিতে তৃতীয় অবস্থান সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপো। তাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯ শতাংশ।
ব্যবসার সাথে মাশুলও
ডিপোর ব্যবসার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে ডিপোগুলোতে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার হার বেড়েছে। এছাড়া, এনবিআর ডিপোতে খালাসের জন্য নতুন পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার ফলে আমদানি কনটেইনার ব্যবস্থাপনাও বেড়েছে। মাশুল বৃদ্ধি আয় বাড়াবে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, রপ্তানি খাতে মাশুল বৃদ্ধির ফলে ডিপোগুলোর লোকসান কমানো সম্ভব হবে। কারণ, আগের চেয়ে রপ্তানিতে খরচের তুলনায় মাশুল কম ছিল, যা এখন বাড়িয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে ডিপোর মাশুল বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি খাত চাপে পড়েছে; রপ্তানিকারকরা বলছেন, মাশুল বৃদ্ধির কারণে রপ্তানির খরচ বেড়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় খাতটি পিছিয়ে পড়তে পারে।
** আমদানি–রপ্তানির পণ্য খালাসে নতুন শর্ত
** ১৫ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন মাশুল কার্যকর
** চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন মাশুল, খরচ বাড়লো ৪১%
** বাড়তে পারে সেবা মাশুল, সুদ, টোল ও ইজারামূল্য
** একই দিনে আইসিডিগামী কনটেইনার সরানোর নির্দেশ
** ‘চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত’
** চট্টগ্রাম বন্দরে ১০০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব
** আমদানি–রপ্তানির পণ্য খালাসে নতুন শর্ত

