নোবিপ্রবির জসীমের ২.৩৫ কোটি টাকা অবৈধ আয়!

নিয়োগ বাণিজ্য আর দুর্নীতির আঁখড়া গড়ে তুলেছেন। তাতে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। আর সেই অবৈধ আয়ের কোন ব্যাখ্যা নেই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) রেজিস্ট্রার মো. জসীম উদ্দিনের কাছে। দুর্নীতির অভিযোগে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত এই রেজিস্ট্রার দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা ২ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার ৩০৩ টাকা অবৈধ আয় খুঁজে পেয়েছে আয়কর বিভাগ। সম্প্রতি আয়কর বিভাগের কুমিল্লা কর অঞ্চলের অধীন নোয়াখালী কর অফিস (সার্কেল-১৩) থেকে অবৈধ এই আয়ের ব্যাখ্যা চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে মো. জসীম উদ্দিনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা। যদিও নিজের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে মো. জসীম উদ্দিন।

জসীম উদ্দিনের ২০২২-২৩ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী, মো. জসীম উদ্দিন ২০২২-২৩ করবর্ষে আয়কর রিটার্নে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার ১৬৭ টাকার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। অর্থাৎ কিভাবে, কোথায় থেকে আয় করেছেন-তার কোন ব্যাখ্যা দেননি। এই আয়ের উপর আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন ৩৯ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৬ টাকা। এই করবর্ষে করদাতা মো. জসীম উদ্দিন আয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩১ হাজার ৪৩৬ টাকা। যার মধ্যে বেতন, বোনাস ও টিএডিএ ১০ লাখ ২৬ লাখ ২৬৯ টাকা। বাকি ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার ১৬৭ টাকা আয়ের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। যাতে করফাঁকি দিয়েছেন ৩৯ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৬ টাকা। ওই করবর্ষে জসীম উদ্দিন দেখিয়েছেন নিজ জমা ৩১ লাখ ২ হাজার টাকা, বেতন ৯ লাখ ৫০ হাজার ৬৯০ টাকা, বোনাস ৬১ হাজার ১৯০ টাকা, সম্মানী ৬০০ টাকা, টিএডিএ ১৪ হাজার ৩৮৯ টাকা, অন্যান্য ব্যাংক হতে জমা ৮৯ লাখ ৫ হাজার ৫৩৭ টাকা, অন্যন্য ব্যক্তি হতে জমা ২৭ লাখ ১৭২ টাকা, রেমিট্যান্স ১ লাখ ৯৬ হাজার ৮৫৮ টাকা ও ঋণ ১০ লাখ টাকা। অপরদিকে, ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী, এই করদাতা ২০২৩-২৪ করবর্ষে মোট আয় দেখিয়েছেন ৮৮ লাখ ৮ হাজার ৮৬২ টাকা। যার মধ্যে ৭৬ লাখ ৬৩ হাজার ১৩৪ টাকা আয়ের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি এই টাকা আয় করেছেন। যাতে করফাঁকি দিয়েছেন ১৮ লাখ ৭১ হাজার ২৭৭ টাকা। মোট আয়ের মধ্যে নিজ জমা দেখিয়েছেন ১৪ লাখ ৬২ হাজার, বেতন ৯ লাখ ৩১ হাজার ৫৫০ টাকা, বোনাস ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ টাকা, সম্মানী ৪১ হাজার ৪০০ টাকা, টিএডিএ ৭৮ হাজার ৩১২ টাকা, অন্যান্য ব্যাংক হতে জমা ৪৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা, অন্যান্য ব্যক্তি হতে জমা ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৯০০ টাকা, রেমিট্যান্স ২৪ হাজার ৩০০ টাকা।

সূত্রমতে, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ করবর্ষে মো. জসীম উদ্দিনের আয়কর ফাইল পুন: উম্মোচন করায় এই আয়কর ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই কর আদায়ে ২৭ জুন মো. জসীম উদ্দিনকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। দুই করবর্ষে আয় করা ২ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার ৩০৩ টাকার উপর ৫৭ লাখ ৯৯ হাজার ৭৩৩ টাকা কর ফাঁকি পাওয়া গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া তথ্য দিয়ে নোবিপ্রবিতে অবৈধভাবে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান মো. জসীম উদ্দীন। যেখানে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পেতে হলে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, সেখানে ৮ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০১২ সালে তিনি এ চাকরি হাতিয়ে নেন। যা পরবর্তী অডিট আপত্তিতে মোটা অংকের টাকা দিয়ে তিনি ধামাচাপা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে বন্দী নোবিপ্রবি‘-শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়-রেজিস্ট্রার জসিম উদ্দিন কর্তৃক দাপ্তরিক নথির ডুপ্লিকেট তৈরি করা। সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণী পরিবর্তন, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা আদায়, প্রতারণা, হুমকি প্রদর্শন এবং নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
NSTU Register
২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর অপর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘নোবিপ্রবিতে রেজিস্ট্রার পদে বিতর্কিত সেই জসিমকে নিয়োগে তোড়জোড়’-শিরোনামে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়-বিতর্কিত ও অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে কয়েকজন যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে ১১ জনের মধ্যে ৪ জনের সাক্ষাৎকার কার্ড ইস্যু করা হয়। এই অবৈধ নিয়োগ সফলভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এবং পিএইচডি সম্পন্ন করা প্রার্থীকেও বাদ দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এই ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়। পরের দিন নোবিপ্রবি উপাচার্য ২৫ নভেম্বর ২০২৩ রেজিস্ট্রার নিয়োগের সাক্ষাৎকার নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসের পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রকল্প ও উন্নয়ন গবেষণা ফাউন্ডেশন সামসুল হক ভবনে নেন বলে জানা যায়।

সূত্রমতে, সম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর নোবিপ্রবির সমন্বয়ক হাসিবুল হোসেন সংবাদ সম্মেলনে এই অযোগ্য রেজিস্ট্রার এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশ করেন মো. জসীম উদ্দিন।

বিবৃতিতে বলা হয়, আমার যাবতীয় ব্যাংকিং লেনদেন রাষ্ট্রায়াত্ত অগ্রণী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম্পাদন করি। এর বাইরে অন্য কোনো ব্যাংকে আমার কোনো হিসাব নেই।অগ্রণী ব্যাংকের উক্ত অ্যাকাউন্টে বর্তমানে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। শুধু বর্তমান নয়; অতীতের কোন সময়েও সেই হিসাবে ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ছিল না। প্রসঙ্গত, আমার বেতন-ভাতার বাইরে উক্ত হিসাবের মাধ্যমে আমার প্রবাসী ভাইয়ের পাঠানো রেমিট্যান্স ও আমার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় একটি মসজিদের কিছু দান-অনুদানের টাকা লেনদেন হয়, সেটিও উত্থাপিত অভিযোগের মতো এত বড় অঙ্কের নয়। সমন্বয়কবৃন্দ ইচ্ছাপোষণ করলে আমার ব্যাংক হিসাবের বিবরণী (স্টেটমেন্ট) তাদের দেখাতে রাজি আছি।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের হিসাব বিবরণী অভিযোগটি অসত্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হলেও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ বিষয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই। আমি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে ২৮ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে নিয়োগ লাভ করি। উক্ত পদে নিয়োগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো নিয়োগ কার্যক্রম সম্পাদিত হয়নি। তারপরও আমার বিষয়ে প্রিয় সমন্বয়কদের উত্থাপিত নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা রাষ্ট্রের যেকোনো কর্তৃপক্ষকে স্বাগত জানাই।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!