Header – Before
Header – After

দেশে মানসিক রোগী ৩ কোটি, চিকিৎসার বাইরে ৯০%

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সংঘাত, বাস্তুচ্যুতি ও মানবিক বিপর্যয় মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্যোগ দেখা দিলে শুধু অবকাঠামো নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের জীবন ও মানসিক স্থিতিও। অথচ দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো অত্যন্ত সীমিত। এর ফলে দ্রুত বাড়ছে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন। তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ এখনো চিকিৎসার বাইরে, আর প্রতি তিনজন ক্ষতিগ্রস্তের একজন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগছেন।

এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মতো আজ শুক্রবার (১০ অক্টবর) বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২৫। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য-‘অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস-মেনটাল হেলথ ইন ক্যাটাস্ট্রোফেস অ্যান্ড ইমার্জেন্সিস’ অর্থাৎ বিপর্যয় কিংবা জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন পাওয়া যায়। এবারের প্রতিপদ্যে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো-মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্তদের জন্য অর্থপূর্ণ সহায়তা ও চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সমাজের প্রচলিত ভুল ধারণা, কলঙ্ক ও বৈষম্য দূর করা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বার্তা দিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব তার বার্তায় বলেন, ‘আমরা এক কঠিন পরীক্ষা ও সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সংঘাত, স্থানচ্যুতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসংখ্য মানুষ মানসিক চাপ ও দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। এই বছরের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী, জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। দিবসটির বার্তায় মহাসচিব জানান, সংঘাতে আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের একজন মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভোগেন, অথচ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও সহায়তা পাওয়া যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি অপরিহার্য। জরুরি প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসাবেই মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং এতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানান, জাতিসংঘের মহাসচিব যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন, বাংলাদেশের চিত্রও প্রায় একইরকম। দেশে দৃশ্যমান দুর্যোগ কম হলেও এখানে প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। দুর্যোগপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর মতো দেশেও মানসিক সচেতনতা ও স্বাস্থ্যের চিকিৎসা ঘাটতি আছে। মানিসক স্বাস্থ্য নিয়ে বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদকাসক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মুনাইম রেজা মুনিম একটি গবেষণা করেছেন। ‘পাথওয়ে টু মেন্টাল হেলথ সার্ভিস’ অর্থাৎ মানসিক রোগীরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবাদাতাদের কাছে পৌঁছাতে কোন কোন ধাপ অতিক্রম করেন। মানসিক সমস্যাজনিত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালটিতে আসা ৫০ জন রোগীর কাছে জানতে চাওয়া হয় কতদিন ধরে রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে এবং একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর আগে রোগীরা কোথায় কোথায় সেবা নিয়েছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে , একজন রোগীর রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাদাতা চিকিৎসকের কাছে যেতে তার সময় লেগে যায় গড়ে ৩৮ মাস। কারও কারও ক্ষেত্রে ২০ বছর পর্যন্ত। এছাড়া সমস্যা দেখা দেওয়ার পর সঠিক মনোরোগ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কাছে আসার আগে গড়ে একজন রোগী পাঁচবার ফার্মাসিস্ট, সাধারণ চিকিৎসক, হুজুর, কবিরাজ বা অন্যদের কাছে গেছেন। শতকরা ২৪ জন যান হুজুর ও কবিরাজের কাছে। ২১ জন যান বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক যেমন : হৃদরোগ, কিডিনরোগ অথবা গ্যাস্ট্রোএন্টিরোলজিস্টের কাছে। ফার্মেসিতে যান ১৭ ভাগ। মাত্র ১৫ শতাংশ যান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মানসিক সমস্যা ও রোগের চিকিৎসার জন্য সারা দেশে সরকারিভাবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, পাবনা মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয়ও রয়েছে এ চিকিৎসাসেবা। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক। কিন্তু এগুলো খুবই ব্যয়বহুল। সরকারি পর্যায়ে রোগীর জন্য শয্যা রয়েছে মাত্র ১২৪০টি, যা রোগীর তুলনায় খুবই অপর্যাপ্ত।

দেশে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ২০১৮-১৯ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি জরিপ চালায়। ওই জরিপ বলছে, দেশে লঘু থেকে গুরুতর মাত্রার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রাপ্তবয়স্ক ১৭ শতাংশ (নারী ১৯ শতাংশ, পুরুষ ১৫ শতাংশ)। ১৮ বছরের নিচের জনগোষ্ঠী ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সব বয়সির মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর (মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও অন্যান্য প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী) সংখ্যা এক হাজারের কম। সমস্যাগ্রস্ত ৯০ শতাংশের বেশি ব্যক্তি চিকিৎসার বাইরে থাকছেন।

আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (আইআইইডি) ২০২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চারগুণ বেড়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. তৈয়বুর রহমান রয়েল বলেন, প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি গভীর মানসিক চাপও সৃষ্টি করে। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরবর্তীতে বিষণ্নতা, একিউট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (ATSD) বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (PTSD) মতো মানসিক রোগে ভুগতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ সময় এসব মানসিক সমস্যা গুরুত্ব পায় না, বিশেষত গ্রামাঞ্চল ও প্রত্যন্ত এলাকায়। ফলে সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে স্থায়ী মানসিক রোগীতে পরিণত হন, যা ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। তাই দুর্যোগকবলিত এলাকায় জরুরি কর্মসূচির অংশ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। এ জন্য সেখানে প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর ও মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে তারা আক্রান্তদের মানসিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারেন।

কর্মসূচি

দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সকাল ৬টায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি)-এর আয়োজনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণে ‘রান ফর মেন্টাল ওয়েলবিং’ শীর্ষক ৫ কিলোমিটার ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে সচেতনতামূলক র‌্যালি ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!