একসময় কেবল অভিজাত শ্রেণির হাতেই দেখা যেত ডায়মন্ডের অলংকার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিলাসবহুল রত্ন এখন পৌঁছে গেছে মধ্যবিত্তদের হাতেও। সহজলভ্যতা ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে রাজধানীর পাশাপাশি বিভাগীয় শহরগুলোতেও নানা ডিজাইনের ডায়মন্ড জুয়েলারির বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। অথচ বিস্ময়করভাবে গত দুই বছরে বৈধ পথে এক ক্যারেট ডায়মন্ডও আমদানি হয়নি। তাহলে এত বিপুল পরিমাণ ডায়মন্ড দেশে আসছে কোথা থেকে—এই প্রশ্ন এখন তদন্ত সংস্থাগুলোরও। বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ব্যবসা করছে, তার বাইরে ঢাকার প্রায় প্রতিটি জুয়েলারি দোকানেই এখন বিক্রি হচ্ছে ডায়মন্ডের অলংকার।
এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে ডায়মন্ড তৈরি হয় না, খনিও নেই। কাস্টমসে যদি বৈধভাবে আমদানির তথ্য না থাকে তাহলে বলা যায়, চোরাচালানের মাধ্যমেই এগুলো দেশে আনা হয়। যারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত শুল্ক গোয়েন্দা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, এ খাতকে যথাযথ মনিটরিংয়ের আওতায় আনলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব।
কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে শিল্পে ব্যবহারের জন্য মাত্র চারটি চালানে মোট ২ কেজি ১৬০ গ্রাম ডায়মন্ড আমদানি হয়েছে। কিন্তু অলংকার তৈরির জন্য কোনো ডায়মন্ড আমদানি হয়নি। অর্থাৎ, দেশের অলংকার বাজার কার্যত পুরোপুরি চোরাচালাননির্ভর। শুল্ক গোয়েন্দা, বিমানবন্দর কাস্টমস, ইমিগ্রেশন পুলিশ ও এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত স্বর্ণের চালান আটক করলেও এখন পর্যন্ত কোনো ডায়মন্ডের চালান ধরা পড়েনি—যা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। অনেকেই বলছেন, ডায়মন্ড সিন্ডিকেট কি তবে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের চেয়েও শক্তিশালী? নাকি বাজারে যেসব ডায়মন্ড বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো আসলে নকল? কাস্টমস ট্যারিফ শিডিউল অনুযায়ী, এক ক্যারেট (০.২ গ্রাম) ডায়মন্ড আমদানিতে দিতে হয় ১৫০ দশমিক ৯০ শতাংশ শুল্ক ও কর। অর্থাৎ ১০০ টাকার ডায়মন্ড আনতে সরকারের রাজস্ব গুনতে হয় প্রায় ১৫০ টাকা।
এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক, ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৪ শতাংশ অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট ও ৪ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি আরোপিত আছে। অন্যদিকে বিদ্যমান ব্যাগেজ রুলে স্বর্ণ ও রুপার বার-অলংকার আমদানির অনুমতি দেওয়া থাকলেও ডায়মন্ডের অলংকারের বিষয়ে কিছু বলা নেই। অর্থাৎ ব্যাগেজ রুলের আওতায় ডায়মন্ডের অলংকার আনার সুযোগ নেই। নীতিমালায় বলা আছে, একজন বিদেশফেরত যাত্রী ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার এবং ২০০ গ্রাম ওজনের রুপার অলংকার বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। আর ২০ ভরি ওজনের (২৩৪ গ্রাম) স্বর্ণ বা রুপার বার শুল্ক দিয়ে আনতে পারবেন। এ জন্য স্বর্ণের ভরিপ্রতি ২ হাজার টাকা এবং রুপার ভরিপ্রতি ৬ টাকা শুল্ক দিতে হবে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, দেশে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের অলংকার বৈধভাবে আমদানি হয়ে না বললেই চলে। তাহলে শপিংমলগুলোতে এত দামি অলংকার কীভাবে আসে? তিনি মনে করেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারি স্বর্ণ নীতিমালা থাকলেও এর সুফল কার্যকরভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। চোরাচালান বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বিমানবন্দরগুলোতে অত্যাধুনিক স্ক্যানিং মেশিন বসানো জরুরি, কিন্তু তা করা হচ্ছে না। কাস্টমস আইনে যাত্রীদের আগাম তথ্য (অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন বা এপিআই) দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বিদেশি এয়ারলাইন্সকে এ বিষয়ে বাধ্য করা হলে কাস্টমস কর্মকর্তারা ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রীদের শনাক্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারত। সবশেষে, চোরাচালান কমানোর জন্য কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা, এপিবিএন, ইমিগ্রেশন, পুলিশের বিশেষ শাখা ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা অপরিহার্য।
অনুসন্ধানের তথ্যমতে, ডায়মন্ড চোরাচালান চক্রের সঙ্গে প্রভাবশালী ও বিদেশি নাগরিক জড়িত। এসব বিদেশি নাগরিক স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করেন। এরা বিভিন্ন ফার্মে কনসালট্যান্ট হিসাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করেন। এর আড়ালে জুয়েলারি মালিকদের অর্ডার সাপেক্ষে শো-রুমে খোলা (লুজ) ও ডায়মন্ডের অলংকার পৌঁছে দেন। এদের কাজই হচ্ছে ডায়মন্ড নিয়ে। এ চক্রটির সঙ্গে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় অবস্থিত জুয়েলারি মালিকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতে সহায়তা করছে কাস্টমসের কয়েকটি অসাধু চক্র। এর বাইরে স্থানীয় উৎস থেকে স্বর্ণের মতো ডায়মন্ডও সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ কেউ ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রয় করলে সেটিকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নতুন অলংকার বানানো হয়।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ২০১৯ সালে আমাদের সমিতি আয়োজিত স্বর্ণ মেলায় জুয়েলারি মালিকরা নিজেদের স্টকে থাকা ডায়মন্ড ঘোষণা দিয়ে বৈধ করে নেন। এরপর তো করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। জুয়েলারি খাতে লাগে মারাত্মক ধাক্কা। চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিতেও এর প্রভাব পড়ে। তাছাড়া ডায়মন্ড সংগ্রহের বড় উৎস হলো রিসাইক্লিং।

