Header – Before
Header – After

তিন খাতে রবির ৩৬৫ কোটি টাকা কর ফাঁকি

করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও তা করযোগ্য হিসেবে দেখায়নি রবি আজিয়াটা লিমিটেড। ফলে ওই আয়ের ওপর প্রতিষ্ঠানটি করও পরিশোধ করেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি করবর্ষে প্রায় ৮১১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার আয় গোপন রেখে রবি কর পরিশোধ করেনি প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা। প্রভিশনকৃত ব্যয়সহ অন্যান্য অননুমোদনযোগ্য খরচ আয় হিসেবে না ধরায় সরকারের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিসিএজি) কার্যালয়ের নিরীক্ষায় এ অনিয়ম ধরা পড়ে। চলতি বছরের ৩ জুলাই প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রবি বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-আয়করের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রবি আজিয়াটা ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০-২১ করবর্ষের রিটার্ন দাখিল করেছে। এতে কোম্পানি করদাতা রিটার্নে মোট আয় দেখিয়েছে ৬০ কোটি ৪১ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৫ টাকা। নিরীক্ষার সময় প্রতিষ্ঠানের আয়কর রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা কম্পিউটেশন অব ট্যাক্সেবল ইনকাম অ্যান্ড ইনকাম ট্যাক্স লায়াবিলিটি, রিপোর্ট অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টস ২০১৯ ও চালানপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অননুমোদনযোগ্য খরচ প্রতিষ্ঠানের আয় হিসেবে যোগ না করে আয়কর কম নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনের নোট-১৭-এ ‘অ্যাসেট রিটায়ারমেন্ট অবলিগেশন (এআরও) খাতে চলতি করবর্ষে চার কোটি ৪৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা প্রভিশন করা হয়।

রবি এ খাতে বাস্তবে পরিশোধ করেছে তিন কোটি ৪৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। কিন্তু অতিরিক্ত ৯৮ লাখ ২০ হাজার টাকা ভবিষ্যতে পরিশোধের কথা বলে অতিরিক্ত প্রভিশন দেখানো হয়েছে। নিরীক্ষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আয়কর দায় নির্ধারণের সময় এই অতিরিক্ত প্রভিশন আয় হিসেবে যোগ না করেই কর হিসাব করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ধারা ২৯ অনুযায়ী, এ ধরনের প্রভিশনকৃত ব্যয় বিয়োজনযোগ্য নয়। ফলে এই ব্যয়কে অননুমোদনযোগ্য হিসেবে আয়ের সঙ্গে যোগ করে মোট করযোগ্য আয় নির্ধারণ করার কথা ছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বার্ষিক প্রতিবেদনের নোট-৩১-এ ‘সেলিং অ্যান্ড ডিস্টিবিউশন এক্সপেন্স’ খাতে ‘ডিলারস কমিশনস’ বাবদ ৭৮৯ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ৫৩ই(১) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে পণ্য বিতরণ বা বিপণন বাবদ কমিশন, ডিসকাউন্ট, ফি, ইনসেনটিভ বা পারফরম্যান্স বোনাস বা পারফরম্যান্স-সংক্রান্ত প্রণোদনা বা অনুরূপ প্রকৃতির অন্য যেকোনো পরিশোধ প্রদানকালে এই পরিশোধকৃত অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য। ১০ শতাংশ হারে এর ওপর প্রযোজ্য উৎসে কর ৭৮ কোটি ৯৫ লাখ ৩২ হাজার ৬০০ টাকা। এ খাতে উৎসে কর কর্তনের কোনো প্রমাণক নিরীক্ষায় পাওয়া যায়নি। ফলে আয়কর অধ্যাদেশের ৩০(এএ) ধারা অনুযায়ী, এই খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের আয়ের সঙ্গে যোগ করে মোট আয় নিরূপণযোগ্য। রবির বার্ষিক প্রতিবেদনের নোট-৩২-এ ‘সিকিউরিটি গার্ড’ বাবদ ২১ কোটি পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ৫২(এএ) ধারা অনুযায়ী, সিকিউরিটি ও ক্লিনিং সেবার গ্রস বিল ভিত্তিমূল্যের ওপর দুই শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য। কিন্তু উৎসে কর কর্তনের কোনো প্রমাণক নিরীক্ষায় না পাওয়ায় ধারা ৩০(এএ) অনুযায়ী, এই আয় অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ করে মোট আয়কর নিরূপণযোগ্য।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, রবি ২০২০-২১ করবর্ষে এই তিন খাতে মোট ৮১১ কোটি ৫৬ লাখ ৮১ হাজার টাকা আয়ের ওপর কর প্রদান করেনি। ওই করবর্ষে ব্যবসা খাতে আয়ের ওপর ৪৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর দাঁড়ায় ৩৬৫ কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫০ টাকা। রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরীক্ষার সময় বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-আয়কর-এর প্রমাণক চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। এলটিইউ জবাবে জানায়, আয়কর রেকর্ড যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী উপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। আর নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়, জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ২৯ অনুযায়ী, প্রভিশনকৃত অননুমোদনযোগ্য খরচ এবং ধারা ৫২(এ), ধারা ৫৩ই(১) মোতাবেক দাবিকৃত খরচের ওপর উৎসে কর কর্তন না করায় এই খরচ আয়ের সঙ্গে যোগ করার বিষয়টি সব বিষয় স্থানীয়ভাবে তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত ছিল। এলটিইউ যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে বলে উল্লেখ করলেও পরবর্তীকালে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানানো হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারি রাজস্ব ক্ষতি-সংক্রান্ত উত্থাপিত আপত্তিটি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে ২০২২ সালের ১৬ জুন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট জারি করা হয়। পরে একই বছরের ১৭ জুলাই তাগাদাপত্র, ৩ আগস্ট আধা-সরকারিপত্র দেয়া হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর ব্রডশিট জবাব দেয়া হয়। এই ব্রডশিটে রাজস্ব আদায়ে এই কার্যক্রম নিষ্পত্তিমূলক জবাব পাওয়া যায়নি। ফলে নিষ্পত্তিমূলক জবাব দিতে ১৬ নভেম্বর আবার চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু প্রায় দুই বছরেও কোনো জবাব দেয়নি এলটিইউ।

এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রভিশনকৃত খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে করে আয় নিরূপণযোগ্য। ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা-ই হয়। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। তবে আয়কর অধ্যাদেশের ধারার মধ্যে পড়লে অ্যাসেসমেন্টের সময় অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ করা হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!