Header – Before
Header – After

ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের উদ্যোগ সরকারের

স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে সরকার একটি ‘বিশেষায়িত ডিফেন্স ইকোনমিক জোন’ বা সামরিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই জোনের মাধ্যমে সশস্ত্র ও আধা-সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয় ড্রোন, সাইবার প্রযুক্তি ব্যবস্থা, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশেই উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে এসব সরঞ্জাম ভবিষ্যতে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করাও এই উদ্যোগের একটি প্রধান উদ্দেশ্য।

কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে রাজস্ব বাজেট, পিপিপি, যৌথ উদ্যোগ ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিরক্ষাখাতের আধুনিকায়ন ও স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি হস্তান্তর, যৌথ বিনিয়োগ, পিপিপি ও এফডিআই সহজ করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে বেশ কিছু নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন।

গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় বিশেষায়িত ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। সভায় উচ্চ পর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের উদীয়মান প্রতিরক্ষা উৎপাদনখাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে ওই সভার কার্যবিবরণীতে উঠে এসেছে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে বেজা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, প্রতিরক্ষা শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিশেষায়িত ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের বিষয়ে কাজ চলছে। জোনটি কোন এলাকায়, কি পরিমাণ জমি নিয়ে স্থাপন করা হবে, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। আমরা এখন পলিসি ও সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে কাজ করছি। বিভিন্ন বন্ধুসুলভ দেশের সঙ্গে কথা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা শিল্পকে রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত করার লক্ষ্যও রয়েছে। আশিক চৌধুরী যিনি একইসঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরও (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান, এই শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী পক্ষগুলোর মধ্যে চীন বা তুরস্ক রয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৩০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা নীতিগত দিকনির্দেশনার অনুমোদন দেন। বেজার চেয়ারম্যানের অনুরোধ পাওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষা শিল্প স্থাপনের জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় নীতিমালার খসড়া ধারণাপত্র (কনসেপ্ট পেপার) প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। বর্তমানে দেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার, যার সঙ্গে বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, আনসার–ভিডিপি ও অন্যান্য আধা-সামরিক সংস্থার বড় ধরনের হার্ডওয়্যার প্রয়োজন যুক্ত হচ্ছে।সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, শক্তিশালী স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে উঠলে অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় অংশ দেশেই পূরণ করা সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যতে রপ্তানির সুযোগও তৈরি হবে। তারা আরও জানান, ইতোমধ্যে সামরিক বাহিনী বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের প্রস্তাব পেয়েছে, একই ধরনের প্রস্তাব এসেছে বিডার কাছেও। তবে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় এসব বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি বিলম্বিত হচ্ছে।

খাতটিতে বেসরকারি বিনিয়োগকে দেওয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার

সভায় অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। তিনি ম্যাকডোনাল্ড ডগলাস ও লকহিড মার্টিনের মতো আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানির উদাহরণ তুলে ধরে প্রতিরক্ষা শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের গুরুত্ব উল্লেখ করেন। অর্থসচিব জানান, এক বছরের বাজেট থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ জোগান দেওয়া সম্ভব না হলেও কয়েক অর্থবছরে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত অব্যবহৃত কারখানার জমিসহ প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণে অর্থ মন্ত্রণালয় পৃষ্ঠপোষকতা দেবে। সামরিক শিল্প গড়ে তুলতে স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে অর্থসচিব বলেন, এতে লক্ষ্য বাস্তবায়নের গতি বাড়বে। এ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা, তবে তারা সতর্ক ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মনিরুজ্জামান বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভরতা একটি কৌশলগত অপরিহার্যতা। তিনি বলেন, সব দেশই প্রতিরক্ষাখাতে স্বনির্ভর হতে চায়। ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপন করা সেই লক্ষ্যের জন্য অপরিহার্য। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে ব্যাপক বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হয়। ১৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতকে বড় আকারে বিনিয়োগে সক্ষম করতে হবে, এবং প্রযুক্তিগত ঘাটতি যৌথ উদ্যোগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। বেসরকারিখাতের সেই বিনিয়োগ সক্ষমতা রয়েছে কি-না, তা যাচাই করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশের প্রতিরক্ষা পণ্যের চাহিদা সীমিত উল্লেখ করে মনিরুজ্জামান বলেন, তাই এখাতে গড়ে উঠা শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে রপ্তানির পথ খুঁজতে হবে। কিন্তু, প্রতিরক্ষা পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ এবং অনেক বড় বড় খেলোয়াড়রা সেখানে নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে খেলছে। তাই রপ্তানির সুযোগ পেতে হলে ওইসব বিদেশি কোম্পানির সরাসরি বিনিয়োগ বা তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে যেতে হবে। তাহলে এটি সম্ভব হবে।

প্রতিরক্ষা পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে

সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান গত চার বছর ধরে প্রতিবছর ৪৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ভারত ২.৭৬ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা শিল্পে ১১.৩ বিলিয়ন ডলার, জার্মানি ৩.৩ বিলিয়ন ডলার, চীন ২.৪ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ৬২১ মিলিয়ন ডলার, তুরস্ক ৬০০ মিলিয়ন ডলার, নেদারল্যান্ড ২৫৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

শক্তিশালী প্রতিরক্ষা শিল্প স্থাপনের উপর গুরুত্ব তুলে ধরে সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা শিল্পে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। অথচ একই ধরণের অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে অনেক দেশ এমন অবস্থানে চলে গেছে, যেখানে পৌঁছাতে আমাদের ন্যূনতম ২৫-৩০ বছর লেগে যাবে। ওই কর্মকর্তা জানান, এখাতের শিল্পে একটি ইকো-সিস্টেম গড়ে তোলা দরকার, যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমদানি ছাড়াই কার্যকর থাকতে পারে।

সভায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, সামরিক শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমপক্ষে পাকিস্তানের সমকক্ষ হবার সামর্থ্য রাখে।তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় যেকোন মূল্যে প্রতিরক্ষা বাহিনী ও শিল্পকে শক্তিশালী করার জন্য এই উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত। ডিফেন্স ইকোনমিক জোন স্থাপনের জন্য গাজীপুরের বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির মতো নির্ধারিত অঞ্চল থাকা উচিত বলেও উল্লেখ করেন বাণিজ্য সচিব।

সভায় এক কর্মকর্তা জানান, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বেসরকারি উদ্যোগে সমরাস্ত্র ও সামরিক যান-সম্পর্কিত শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে, এবং দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো চাইলে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত গ্যারান্টি ও আইনি সুরক্ষা চান, যা বর্তমান আইন ও নীতিমালায় স্পষ্টভাবে নির্ধারিত নয়। তাই বিনিয়োগের ধরন ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে—এসব বিষয় আসন্ন নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।

প্রক্রিয়া তদারকিতে গঠিত হলো দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি

বৈঠকে দুটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়— ১.’প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন সম্পর্কিত জাতীয় নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টাকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২.সামগ্রিক অগ্রগতি তদারকির জন্য ‘বাংলাদেশ জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প-উন্নয়ন সমন্বয় পরিষদ’ নামে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!