ব্যবসায়ীদের আপত্তি ও আলোচনার আহ্বান উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত বাড়তি ট্যারিফ (মাশুল) কার্যকর করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্তে বন্দরের ৫৬টি সেবা খাতে গড়ে ৪১ শতাংশ হারে ট্যারিফ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বন্দরের ভাড়া, টোল, ফি ও ট্যারিফ ডলারের বিনিময় মূল্যের ভিত্তিতে আদায় করা হবে, যেখানে প্রতি ডলারের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১২২ টাকা। অর্থাৎ, ডলারের দাম বাড়লে মাশুলও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। তবে ব্যবসায়ীরা এই সিদ্ধান্তকে একতরফা ও আত্মঘাতী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া চিঠির ইতিবাচক সাড়া আশা করছেন তারা।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক এক লাফে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ট্যারিফ বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যবসায়ীরা চেয়েছিলেন, ট্যারিফ ধাপে ধাপে ও যৌক্তিক হারে বাড়ানো হোক, কিন্তু সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ মনে করেন, ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রভাব শুধু ব্যবসায়ীদের নয়, ভোক্তাদের ওপরও পড়বে। তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ট্যারিফ বাড়ানোর পর শিপিং কোম্পানিগুলোও তাদের চার্জ সমন্বয় করছে, ফলে জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানির খরচ বেড়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরও বেশি দাম গুনতে হবে।
ট্যারিফের যে গেজেট প্রকাশ করা হয়, তা পর্যালোচনায় দেখা যায়, পণ্যভর্তি ২০ ফুটের প্রতি টিইইউস কনটেইনারে বর্তমানে গড়ে মাশুল দিতে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। এর আগে যা গড়ে ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। নতুন ট্যারিফ অনুযায়ী, কনটেইনার ওঠানো-নামানোতে চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৮ ডলার, যা আগে ছিল ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার। আবার ২০ ফুটের প্রতি টিইইউস কনটেইনারের জন্য গ্যান্ট্রি ক্রেন চার্জ ধরা হয়েছে ২০ দশমিক ৮০ ডলার, এর আগে যা ছিল ১৫ ডলার। একইভাবে জাহাজের বিদ্যমান পাইলটিং চার্জ মাশুল ৩৫৭ ডলার হলেও নতুন সিদ্ধান্তে ধরা হয়েছে ৮০০ ডলার।
গেজেটে আরও উল্লেখ রয়েছে, প্রতিবার বন্দর এলাকায় প্রবেশের জন্য প্রতি গ্রজ টনের জন্য শূন্য দশমিক ৩০৬ ডলার, পোর্ট লিমিটের মধ্যে লাইটার ও ট্যাঙ্কারের ভ্যাসেল ওয়ার্কিং চার্জ ধরা হয়েছে প্রতি গ্রজ টনে শূন্য দশমিক ১৭ ডলার। এর সঙ্গে ডেঞ্জারাস গুডস ভ্যাসেলের ক্ষেত্রে ঘোষিত চার্জে ২৫ শতাংশ, ডেড ভ্যাসেলের জন্য ৫০ শতাংশ, লাইটারেজের জন্য ৫০ শতাংশ, ডিলে অথবা ওভার স্টে চার্জ হিসেবে ৫ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্তত ৫৬ খাতে এভাবে কমবেশি হারে মাশুল বাড়বে। এমনকি ভোগ্যপণ্যেও প্রভাব ফেলবে। কারণ আমদানি করা রসুন, আদা, ফল ও মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যে রেফার কনটেইনারে মাশুল বাড়বে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে রপ্তানিকৃত পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। এ ছাড়া আমদানি পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গম, সার ও শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে দেশে প্রত্যক্ষভাবে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরের আস্থা কমে যাবে আন্তর্জাতিক শিপিং কমিউনিটি সেন্টারে।
এমন পরিস্থিতিতে বাড়তি ট্যারিফ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরাম। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে সংগঠনটির আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী স্বাক্ষর করেন। চিঠিতে বলা হয়, ট্যারিফ বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থায় আঘাত হানবে এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি ব্যয়বহুল বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করবে। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুকের মতে, সেবার মান বাড়ানোর অংশ হিসেবেই ট্যারিফ সমন্বয় করা হয়েছে। তিনি জানান, নতুন ট্যারিফ মঙ্গলবার রাত ১২টার পর থেকে কার্যকর হয়েছে।
** বাড়তি মাশুল আরোপে ৭ জাহাজের অনুমতি বাতিল
** চট্টগ্রাম বন্দরে বাড়তি মাশুল কার্যকর
** চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল স্থগিতের দাবি ব্যবসায়ীদের
** ১৫ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন মাশুল কার্যকর
** চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন মাশুল, খরচ বাড়লো ৪১%
** বাড়তে পারে সেবা মাশুল, সুদ, টোল ও ইজারামূল্য
** একই দিনে আইসিডিগামী কনটেইনার সরানোর নির্দেশ
** ‘চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত’
** চট্টগ্রাম বন্দরে ১০০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব
** আমদানি–রপ্তানির পণ্য খালাসে নতুন শর্ত

