জিপিএইচ ইস্পাতের খাল দখলের সত্যতা পেল ‘বেলা’

সরেজমিন পরিদর্শন করে জিপিএইচ ইস্পাতের খাল দখলের সত্যতা পেয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড এলাকায় মছজিদ্দা গ্রাম ও জিপিএইচ ইস্পাত কারখানা এলাকা পরিদর্শন করে বেলা টিম। ওই টিমের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর মনিরা পারভীন। মনিরা পারভীন বলেন, বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে ২/৩ মাস হলো, এখনও আমরা জলাবদ্ধতা দেখতে পেয়েছি। একটি স্কুল ভিজিট করেছি সেখানেও জলাবদ্ধতার আলামত (স্যাঁতসেঁতে) দেখতে পেয়েছি।

তিনি বলেন, জিপিএইচ ইস্পাত ২০২১ সালে কারখানা সম্প্রসারণের সময় খাল ভরাট করার পর থেকেই জলাবদ্ধতার শুরু হয়েছে। গ্রামবাসী তখন অভিযোগ দিলে পরিবেশ অধিদপ্তর জিপিএইচ ইস্পাত কর্তৃপক্ষকে তলব করে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকারনামা দিয়ে আসে। ফিরে এসে তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে ফলাফল হয়েছে ‍উল্টো। আগে ৪ শতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার শিকার হতো, এখন চার থেকে পাঁচ হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, খাল উদ্ধার ছাড়া এই জলাবদ্ধতা দূর করার কোন পথ নেই। অবশ্যই পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
GPH ispat 2
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মছজিদ্দা গ্রামের অবস্থা আগে এমন ছিল না। একদিকে সাগর, অন্যদিকে পাহাড়—সব মিলিয়ে সবুজে ঘেরা শান্ত একটি গ্রাম ছিল এটি। নানারকম সবজি চাষের জন্যও গ্রামটি পরিচিত ছিল। এখন সেই চিত্র বদলে যাচ্ছে। দাশপাড়া অনেক আগেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দখলে চলে গেছে। সেখানে প্রায় চার শতাধিক হিন্দু পরিবার বাস করতেন, কিন্তু চাপের মুখে তারা ঘরবাড়ি ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অভিযোগ আছে, অনেকের জমি জোর করে দখল করা হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে উত্তরপাড়ার বাসিন্দারাও বাড়িঘর নিয়ে সরে যাওয়ার পথ খুঁজছেন।

২০১৮ সালের দিকে কারখানা সম্প্রসারণের সময় রাস্তা, ব্রীজ, খাল সবই গিলে খেয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত। মছজিদ্দা গ্রামের পুর্বদিকে প্রায় ৬ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত জঙ্গলবাঁশবাড়িয়া পাহাড় (৫০ হাজার একর) আর পশ্চিম দিকে অবস্থিত সাগর। পাহাড় এবং সাগরের মাঝ বরাবর রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। আর মহাসড়কের পূর্বদিকে অবস্থিত মছজিদ্দা গ্রামটি। ঐতিহাসিকভাবেই পাহাড়ের পানি বিভিন্ন ঝিরির মাধ্যমে নেমে আসে মহাসড়কের পুর্বদিকের ৪০ ফুট প্রশস্ত খালে। সেই খালের পানি দক্ষিণ মছজিদ্দা ব্রীজের (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) নিচ দিয়ে সাগরে চলে যেতো। আর সেই খালটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানা। পানি নিষ্কাশনের জন্য মাটির নিচ দিয়ে একটি রিং বসানো হয়েছে, যা একদিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়, একই সঙ্গে উচু করে বসানোর কারণে গ্রামটিতে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকছে। পাশাপাশি ১৬ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি ব্রীজ ভেঙ্গে ৫ ফুট করা হয়েছে। যে কারণে পুরো বর্ষা মৌসুম বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে থাকছে।

গ্রামবাসী দফায় দফায় লিখিত অভিযোগ দিলেও কোন সুরাহা হয়নি। শুধু চিঠি চালাচালি চলছে, ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে, উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা, ইউএনও, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, পিবিআই, সিআইডি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তদন্তেও সত্যতা উঠে এসেছে। তারা শুধুই চিঠি চালাচালি করে দায় সারছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগি গ্রামবাসী আবুল কালাম (পিতা আব্দুল মালেক)। জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার উত্তরদিকে তার কয়েক পূরুষের বসতভিটা।
GPH ispat 3
সীতাকুণ্ড উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার ছৌজি চাকমার রিপোর্টেও ভয়াবহতা উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন, সরেজমিন তদন্তে দেখা যায় মছজিদ্দা মৌজায় বিএস ৪৪৬০ এবং ৩৪৪ দাগের জমি রাস্তা/সড়ক শ্রেণির জমি। তদন্তকালে জানা যায়, বর্ণিত রাস্তার নিচ দিয়ে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড প্রায় ৭ ফুটের প্রস্থ বিশিষ্ট পাইপ বসিয়েছেন। ফলে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের পানি পূর্বের ন্যায় কুমিরা খালে না পড়ে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড কর্তৃক নির্মিত পাইপ দিয়ে পানি মগপুকুর এলাকায় ঢুকে পড়ে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেষে বয়ে চলা আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ ফুট চওড়া খাল ভরাট করায় উক্ত খাল দিয়ে পানি বা বর্জ্য অপসারণ বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই আশাপাশের ৪০০ পরিবার পানি বন্দী হয়ে পড়ে। এ ছাড়া জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড ১৬ ফুটের ব্রিজ ভেঙ্গে ৫ ফুট করে ফেলে এবং উচু করেছে। ফলে উত্তর দিকের পানি দক্ষিণ দিকে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের চিঠির প্রেক্ষিতে খালটি উদ্ধারের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই চিঠির কার‌্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না। শুধু জলাবদ্ধতা নয় কারখানার বিষাক্ত পানি ছেড়ে দিচ্ছে উত্তরে অবস্থিত মগপুকুরে। স্থানীয়দের মিঠাপানির প্রধান উৎসটি ভয়াবহ দূষণের শিকার। সেখানে প্রায়শই মরা মাছ ভেসে উঠছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!