Header – Before
Header – After

জিআই পণ্যের ব্র্যান্ডিং নেই

ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে। তবে এই পণ্যের জন্য দেশের অধিকার রক্ষা করা এবং বিদেশে জনপ্রিয় করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে জিআই স্বীকৃত পণ্যগুলোর ভালো দাম পাচ্ছে না এবং রপ্তানি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পণ্যের ব্র্যান্ডিং, বাজারে প্রবেশ, জিআই ট্যাগের ব্যবহার নীতি, খাতভিত্তিক কৌশল, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অতিরিক্ত পরিবহন খরচসহ নানা কারণে রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাছাড়া পণ্যের প্রচার ও প্রসারও খুব সীমিত। এর ফলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে জিআই পণ্যের পরিচিতি বাড়ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, ব্যবসায়ী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসহ অংশীজনদের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় জিআই স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভাবনাময় পণ্য থেকে বাংলাদেশ কোনো সুফল পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, স্বাদ ও মানের দিক থেকে বাংলাদেশের পণ্য মানসম্পন্ন হলেও যথাযথ সার্টিফিকেশনের অভাবে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে পণ্য আটকে যায়। যদি আমদানিকারক দেশগুলোর সার্টিফিকেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করা না হয়, তবে জিআই ট্যাগ কার্যকর হবে না। এজন্য জিআই পণ্য উৎপাদনকারীদের একটি সমন্বিত অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠন গঠন করা জরুরি।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে দেশের জিআই পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারে সমাদৃত করা সম্ভব। এজন্য রপ্তানিতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া, সরকারিভাবে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, বিমান ভাড়া কমানো এবং বিভাগীয় পর্যায়ে ল্যাবরেটরি স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এছাড়া জিআই পণ্যের আবেদন প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আবেদন করতে পারেন না। তাই আবেদন প্রক্রিয়া আরও সহজ করা প্রয়োজন।

জিআই পণ্য কী

জিআই মানে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন বা ভৌগোলিক নির্দেশক। এটি এমন একটি স্বীকৃতি, যা কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার বিশেষ গুণগত মান বা খ্যাতি নির্দেশ করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) জিআই স্বীকৃতি প্রদান করে।

জিআই স্বীকৃত পণ্য ক্রেতাদের কাছে উৎস ও সত্যতার নিশ্চয়তা দেয় এবং ভালো দাম পেতে সাহায্য করে। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ক্রেতারা সাধারণত পণ্যের উৎসকে গুরুত্ব দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গবেষণায় দেখা গেছে, জিআই স্বীকৃত পণ্যের দাম একই ধরনের সাধারণ পণ্যের তুলনায় ২০–৫০ শতাংশ বেশি হয়। বাংলাদেশ ১৯৮৫ সালে ডব্লিউআইপিওর সদস্য হয়, তবে এখনও লিসবন সিস্টেমের (যা জিআইর বহুজাতিক নিবন্ধন ব্যবস্থা) সদস্য নয়। লিসবন সিস্টেমে একবার জিআই নিবন্ধন করলেই বহু দেশে একসাথে সুরক্ষা পাওয়া যায়, যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং বাজার সম্প্রসারণে সহায়ক।

জিআই পণ্যের ট্যাগ তৈরি হয়নি এখনও

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) গবেষণা পরিচালক ড. ওয়াসেল বিন সাদাত জিআই পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ ও উৎপাদনকারীদের সংগঠিত করার গুরুত্বের উপর জোর দেন। তিনি বলেন, যদিও জিআই পণ্যের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সাফল্য এসেছে, তবে প্রায় ৯০ শতাংশ আবেদন এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। জিআই পণ্যের ব্র্যান্ডিং, বাজার সম্প্রসারণ ও রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়াতে জিআই ট্যাগ, জিআই ট্যাগ ব্যবহার নীতি, খাতভিত্তিক কৌশল, সার্টিফিকেশন ও ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম চালু করা অত্যন্ত জরুরি।

জিআই নিবন্ধনের প্রক্রিয়া

নিবন্ধনের জন্য প্রথমে আবেদন করতে হবে। পণ্যের উৎপাদনকারী, আহরণকারী, প্রস্তুতকারী বা প্রক্রিয়াজাতকারী ডিপিডিটিতে আবেদন করতে পারেন। ডিপিডিটির নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় তথ্য, প্রমাণসহ আবেদন করতে হবে। নিবন্ধন পেতে আইন অনুযায়ী নির্ধারিত ফি প্রদান করতে হবে। এরপর ডিপিডিটি আবেদনপত্রটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করবে। সংশ্লিষ্ট পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণাদি পরীক্ষা করা হবে। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আইন অনুযায়ী নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

জিআই পণ্য ৬০টি

ভৌগোলিক নির্দেশক (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ প্রণয়নের পর থেকে দেশে ৬০টি পণ্যকে জিআই হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়েছে। ডিপিডিটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রথম জিআই স্বীকৃত পণ্য হলো নারায়ণগঞ্জে শত শত বছর ধরে উৎপাদিত জামদানি শাড়ি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে জামদানি শাড়িকে এই সনদ দেওয়া হয়। এরপর থেকে মোট ৬০টি পণ্যকে জিআই সনদ দেওয়া হয়েছে। এ পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে—টাঙ্গাইল শাড়ি, জামালপুরের নকশিকাঁথা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, রাজশাহীর মিষ্টি পান, নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা, যশোরের খেজুরের গুড়, মুক্তাগাছার মণ্ডা, মৌলভীবাজারের আগর আতর, মৌলভীবাজারের আগর, রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, বগুড়ার দই, বাংলাদেশের শীতলপাটি, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, বাংলাদেশের কালিজিরা, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বিজয়পুরের সাদামাটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম এবং বাংলাদেশের ইলিশ।

চলতি বছরের এপ্রিলে একসঙ্গে ২৪টি পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে—সিরাজগঞ্জের গামছা ও লুঙ্গি, মিরপুরের কাতান শাড়ি, সিলেটের মণিপুরি শাড়ি, কুমিল্লার খাদি, কুমারখালীর বেডশিট, ঢাকাই ফুটি কার্পাস তুলা ও এর বীজ ও গাছ, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের জামুর্কির সন্দেশ, নওগাঁর নাক ফজলি আম, মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর, দিনাজপুরের বেদানা লিচু, বরিশালের আমড়া, অষ্টগ্রামের পনির, কিশোরগঞ্জের রাতা বোরো ধান, গাজীপুরের কাঁঠাল, শেরপুরের ছানার পায়েস, সুন্দরবনের মধু, গোপালগঞ্জের ব্রোঞ্জের গহনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টি, মাগুরার হাজরাপুরী লিচু, ভোলার মহিষের দুধের কাঁচা দই, মধুপুরের আনারস এবং নরসিংদীর লটকন। এরপর আরও পাঁচটি পণ্য জিআই সনদ লাভ করেছে—মেহেরপুরের মেহের সাগর কলা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি, মেহেরপুরের হিমসাগর আম এবং ফরিদপুরের পাট। সর্বশেষ জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে ফরিদপুরের পাট।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!