জালিয়াতি করায় বাদ পড়ছে জেনেক্স!

** চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করায় জেনেক্সকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
** এক মেশিন দেখিয়ে আরেক মেশিন স্থাপন
** মেশিনের মেমোরিতে ডেটা ২ বছর থাকার কথা থাকলেও ডেটা পাওয়া যায়নি

খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় বাড়াতে ঢাকঢোল পিঠিয়ে ইএফডি মেশিন স্থাপন শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই মেশিনে ভ্যাট দিতে ভোক্তাদের উৎসাহিত করতে লটারির মাধ্যমে আর্থিক পুরস্কারের বিধানও চালু করে। কিন্তু পর্যাপ্ত মেশিন বসাতে না পারায় পুরো কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তাই ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করতে ইএফডির পরিবর্তে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে সংস্থাটি। একইসঙ্গে লক্ষ্য অনুযায়ী মেশিন স্থাপন করতে না পারা, জালিয়াতি ও চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান এই কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে। সব শর্ত ভঙ্গ ও জালিয়াতি করায় চুক্তি বাতিল হতে পারে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ইএফডি মেশিনে ভ্যাট আদায় কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে একটি ফাংশনাল ও একটি টেকনিক্যাল কমিটি করে এনবিআর। কমিটি দুটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিস। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা মেশিন স্থাপন করতে পারেনি। কমিটির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ২৮ অক্টোবর কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে আগামী ২৮ কার্যদিবসের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব পাওয়া না গেলে এনবিআরে রক্ষিত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর চুক্তির এক বছর পূর্তি হওয়ায় ২০ হাজার ইএফডি মেশিন বসানোর কথা ছিল। পরবর্তীতে সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই সংখ্যক মেশিন বসানোর জন্য ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে তিনটি জোনে জেনেক্স মেশিন বসাতে পেরেছে ১৫ হাজার ৯৯৫টি। এর মধ্যে ১২ হাজার ডিভাইস প্রকৃত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ডিভাইসগুলো সিস্টেমে পেয়ারিং অবস্থায় ছিল।

এনবিআরের সঙ্গে চুক্তির শর্তে বলা হয়েছে, ইএফডি/এসডিসি ডিভাইসগুলো চীনের একটি কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হবে। কিন্তু টেকনিক্যাল কমিটির পর্যবেক্ষণ বলছে, ওই কোম্পানির পরিবর্তে অন্য ব্র্যান্ডের ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে। এরকম ১৫ হাজার ৬০০টি ডিভাইস আমদানি করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসানো হয়েছে। ডিভাইসে বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের ফিচার থাকার কথা ছিল। তবে বাস্তবে তার কিছুই পায়নি টেকনিক্যাল কমিটি। মেশিনে ২ বছরের তথ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা সম্পন্ন ফিসক্যাল মেমরি, ডিভাইসে ট্রানজেকশন ডেটা সংবলিত ডিজিটাল সার্টিফিকেট ফিচার, ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক সিম, এসডিসি স্ট্যাটাস ডিসপ্লে মডেল এবং করদাতার তথ্যসহ ফিচার থাকার শর্ত ছিল। কিন্তু জেনেক্সের বসানো মেশিনে এসব ফিচার পাওয়া যায়নি। তাছাড়া চুক্তিতে এনবিআর কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ ও কারখানা পরিদর্শন, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং মেশিন ব্যবহারকারীদের ৬ ঘণ্টা করে ৩ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়ার শর্ত ছিল। সেই শর্ত পূরণ করেনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে জানতে জেনেক্স ইনফোসিসের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স আশিকুর রহমান বলেন, মেশিন বসানোর যে প্রত্যাশা ছিল সেটা পূরণ করতে গিয়ে মাঠ পর্যায়ের দোকান মালিক সমিতি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অসহযোগিতা পেয়েছি। এমনকি জেনেক্স ইনফোসিসের কর্মীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাঞ্ছিত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে দোকানদারকে ডিভাইস বসানোর ব্যাপারে বাধ্য করার কোনো টুলস আমাদের হাতে ছিল না। ইএফডি মেশিন ব্যবহারের জন্য এনবিআরে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তদারকি করলে আমাদের সফলতার হার আরও বেড়ে যেত।

তিনি আরও বলেন, চুক্তি অনুযায়ী এসিনো করপোরেশন থেকে মেশিন বসানোর কথা থাকলেও তাদের অপারেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা ডিভাইস আমদানি করতে পারিনি। এছাড়া গ্রাহকদের পরবর্তী প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার জটিলতা (আফটার সেল সার্ভিস) বিবেচনায় আমরা অন্য ব্রান্ডের আরও উন্নতমানের মেশিন সরবরাহ করেছি। এসব মেশিনের ইন্টারন্যাল মেমোরির মাধ্যমে দুই বছরের ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে। ফলে ফিসক্যাল মেমোরির বিষয়টি অসুবিধা তৈরি করছে না। তাছাড়া ডলারে কৃচ্ছ তা সাধনে সরকারি আদেশকে আমলে নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তাদের জন্য চীনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। তবে এই প্রকল্পের সফলতা বা ব্যর্থতার এটি কোনোভাবে প্রভাবিত করবে না।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ১৫ মে খুচরা পর্যায়ে ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে এনবিআর। এতে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পাওয়ায় ২০১৮ সালে অত্যাধুনিক ইএফডি মেশিন বসানোর পরিকল্পনা নেয় সংস্থাটি। কিন্তু শুরুতেই বাধে জটিলতা। এনবিআর সিদ্ধান্ত নেয় খুচরা ব্যবসায়ীদের এককালীন ২০ হাজার ৫৩৩ টাকা বা ৩ মাসের কিস্তিতে ইএফডি মেশিন ভেন্ডরদের কাছ থেকে কিনতে হবে। এতে ব্যবসায়ীদের সাড়া না পাওয়ায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এনবিআর। বিনা মূল্যে মেশিন সরবরাহে প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসের সঙ্গে ২০২২ সালের নভেম্বরে চুক্তি করে সংস্থাটি।

*** জেনেক্সের জালিয়াতি: ইএফডি মেশিন বসাতে ‘ঘাপলা’
** পাচার ও পুঁজিবাজার কারসাজির ‘মাস্টার’ আদনান

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!