ছয় বছরে মানব চুলের রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ

ফেলে দেওয়া মানুষের চুল এখন কোটি ডলারের ব্যবসার মূল উপাদান। এটি শুধু অর্থ নয়, সম্ভাবনার প্রতীকও বটে। প্রায় তিন দশক আগে শুরু হওয়া এই অপ্রচলিত উদ্যোগ আজ দেশে পূর্ণাঙ্গ শিল্পে পরিণত হয়েছে। মানব চুলকে কাঁচামাল হিসেবে নিশ্চিত করতে সারা দেশে একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, যার কেন্দ্রবিন্দু অন্তত ২৫টি কারখানা। এই কারখানাগুলোতে তৈরি পণ্য শুধুমাত্র দেশীয় চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও ব্যাপক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ইপিজেডে কিছু বিদেশি কারখানাও সরাসরি এসব পণ্য রপ্তানি করছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় বছরে মানব চুল ও কৃত্রিম চুলের রপ্তানি প্রায় সাড়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার ডলার। ২০২০-২১ সালে এটি ৭৫.৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৭১ কোটি ডলারে পৌঁছায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আরও ৮৫.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১০.৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২০২২-২৩ সালে রপ্তানি ১২.৩০ কোটি ডলারে পৌঁছায়, যদিও ২০২৩-২৪ সালে বৈশ্বিক কারণে ৩.৯৫ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি ২০.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর), দেশ থেকে মানব চুল ও উইগস রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি। এ বিষয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, প্রোডাক্ট ডাইভারসিফিকেশনকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। নন-ট্র্যাডিশনাল পণ্যের মধ্যে মানব চুলের বাজারে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, যেখানে ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের রপ্তানি ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, সেখানে মানব চুল খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধি এ খাতের বিশাল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

দেশে মানব চুলের প্রথম উদ্যোক্তা খিলগাঁওয়ের মতিউর রহমান। প্রায় তিন দশক আগে তিনি বাড়ি বাড়ি ও পারলারে ঘুরে চুল সংগ্রহ শুরু করেন। পরিবার ও সমাজ সমর্থন না করলেও তিনি থেমে যাননি। সংগ্রহ করা চুল প্রক্রিয়াজাত করে উইগস, হেয়ার এক্সটেনশনসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। পরে প্রতিষ্ঠা করেন চুলের কারখানা ‘হেয়ারি’। গত ২৯ বছরে তাঁর ব্যবসাসহ এ খাতের সার্বিক বাজার, কারখানা ও হকার—সবই বেড়েছে। তাঁর নরসিংদীর কারখানায় স্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন ৩০ জন।

তথ্যমতে, দেশীয় কারখানাগুলো মাসে গড়ে ২০ কেজি চুল সংগ্রহ করে। ৮ ইঞ্চি চুলের দাম ৮-৯ হাজার টাকা, বড় চুলের ক্ষেত্রে ৫০-৬০ হাজার টাকা। বছরে দেশে সংগৃহীত চুলের পরিমাণ প্রায় ৫ টন, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। পণ্য তৈরিতে ৫০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হলে চুলের সার্বিক বাজার দাঁড়ায় ৮ কোটি টাকার আশপাশে। বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি পণ্য রপ্তানি হলে এর মূল্য পৌঁছায় ১৪ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকায়।

মানব চুল সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ হয় চার ধাপে। হকারদেরও ভালো উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। যাত্রাবাড়ীর মো. রাফসান জানি বলেন, তাঁরা সারা দিনে ১০০-১৫০ গ্রাম চুল সংগ্রহ করেন, যা ৩-৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয় এবং নিয়মিত আয় নিশ্চিত হয়।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চুল ও উইগসের চাহিদি দ্রুত বাড়ছে। চীন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, ইউরোপ ও আমেরিকায় এই পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। বৈশ্বিক মানব চুলের বাজারের আকার প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলার, যা বছরে ১১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানব চুল রপ্তানিতে ভারত বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে এবং বৈশ্বিক চাহিদার ৮৫ শতাংশ সরবরাহ করছে। এক্সটেনশন ও উইগের প্রধান বাজার উত্তর আমেরিকায়, যেখানে ২০২৪ সালে ৪৭.১৩ শতাংশ অংশ তাদের দখলে ছিল।

তবে বাজার সম্প্রসারণে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। অনেক নারী মনে করেন ফেলে দেওয়া চুল বিক্রি করলে অমঙ্গল হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে দেশের নারীরা চুল কাটা কমই করেন। এছাড়া তৈরি পণ্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পাঠানো জটিল হয়ে ওঠে। কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোও চুলকে মানব অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে সরবরাহে অনীহা দেখায়। এছাড়া উচ্চমূল্যের পণ্যের জন্য হকারদের অগ্রিম টাকা দিতে হয় এবং অনেক উদ্যোক্তার পুঁজি সীমিত থাকায় ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!