তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান একমি পেস্টিসাইডস লিমিটেড গত চার করবর্ষে সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধের সময় কোনো উৎসে কর প্রদান করেনি। তবে কর না দেওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়মিতভাবে উৎসে কর পরিশোধের সনদ দিয়েছে কর অঞ্চল-১-এর একটি সিন্ডিকেট। এর ফলে সরকার প্রায় ২৫ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারিয়েছে। শুধু সরবরাহকারীদের অর্থ প্রদান নয়, সম্পদ ক্রয়ের ক্ষেত্রেও কোম্পানিটি উৎসে কর ফাঁকি দিয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, আয়কর খাতের রাজস্বের বড় অংশ আসে উৎসে কর থেকে। আয়কর আইনে কোম্পানির সরবরাহ, প্রচার–প্রচারণা থেকে শুরু করে সম্পদ ক্রয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎসে কর নির্ধারিত রয়েছে, যা আদায়ের দায়িত্বে থাকেন আয়কর কর্মকর্তারা। কিন্তু কর অঞ্চল-১-এর একটি সার্কেলে এই উৎসে কর আদায়কে কেন্দ্র করে ঘটেছে বড় ধরনের জালিয়াতি। কোম্পানি ও কিছু অসাধু আয়কর কর্মকর্তার যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে এ জালিয়াতি চলছে।
একমি পেস্টিসাইডসের এই কর ফাঁকির বিষয়টি সম্প্রতি কর অঞ্চল-১-এর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় ধরা পড়ে। নিরীক্ষায় কোম্পানির আয়কর ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন কর অঞ্চল-১-এর কর্মকর্তারা। তবে এ বিষয়ে জানতে একমি পেস্টিসাইডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজা-উর রহমান সিনহার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরবর্তীতে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, একমি পেস্টিসাইডস লিমিটেডের আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২০-২১ করবর্ষে সরবরাহকারীদের কাছে পরিশোধ করেছে ১০২ কোটি ৫৪ লাখ ১৪ হাজার ৯৩৭ টাকা। একই সময়ে কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় করেছে ১২ কোটি ৯১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৫ টাকা এবং অন্যান্য খাতে পেমেন্টের পরিমাণ দেখিয়েছে ৯ কোটি ৩২ লাখ ৮ হাজার ৫৬৯ টাকা।
পরবর্তী করবর্ষ ২০২১-২২ সালে সরবরাহকারীদের অর্থ প্রদান দেখানো হয়েছে ১১২ কোটি ৪২ লাখ ৯৮ হাজার ২৫৭ টাকা। ওই সময়ে কর্মচারীদের বেতন বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১৪ কোটি ২৯ লাখ ২৪ হাজার ৩২৮ টাকা এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ৫০ লাখ ১০ হাজার ১১৬ টাকা।
সূত্রের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ করবর্ষে একমি পেস্টিসাইডস লিমিটেড সরবরাহকারীদের কাছে পরিশোধ করেছে ১১১ কোটি ১২ লাখ ২৮ হাজার ৭৭০ টাকা। একই সময়ে কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৪ কোটি ৫৫ লাখ ২৯ হাজার ৬৩৮ টাকা এবং অন্যান্য খাতে পেমেন্ট দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ৫২১ টাকা।পরবর্তী ২০২৩-২৪ করবর্ষে সরবরাহকারীদের অর্থ প্রদান দেখানো হয়েছে ১০২ কোটি ৭৬ লাখ ৪ হাজার ৮৫৬ টাকা, কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৯ কোটি ৫ লাখ ৬৬ হাজার ১৬২ টাকা এবং অন্যান্য খাতে ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭১ হাজার ৮৯৬ টাকা।
সব মিলিয়ে গত চার করবর্ষে প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহকারীদের পরিশোধ করেছে মোট ৪২৮ কোটি ৮৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮২০ টাকা, কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় করেছে ৫০ কোটি ৮১ লাখ ৯৬ হাজার ১৭৩ টাকা এবং অন্যান্য খাতে খরচ করেছে ৩২ কোটি ৯৩ লাখ ৭২ হাজার ১০২ টাকা। অর্থাৎ, চার করবর্ষে কোম্পানিটির মোট ব্যয় হয়েছে ৫১২ কোটি ৬১ লাখ ১৫ হাজার ৯৫ টাকা। তবে এ বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রদানের পরও উৎসে কর প্রদানের কোনো চালান কর সার্কেলে জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্ট করবর্ষে সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর নির্ধারিত ছিল ৫ শতাংশ। সেই হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির কর ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ কোটি টাকারও বেশি। বিষয়টি উল্লেখ করে একমি পেস্টিসাইডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ব্যাখ্যা দিতে চিঠি পাঠিয়েছে কর অঞ্চল-১।
শুধু ব্যয়ের ক্ষেত্রেই নয়, সম্পদ কেনার ক্ষেত্রেও কোম্পানিটির উৎসে কর না দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন কর কর্মকর্তারা। আলোচ্য সময়ে একমি পেস্টিসাইজ ৭৪ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার ৬২ টাকার সম্পদ ক্রয় করলেও উৎসে কর দেয়নি। এ ছাড়া বর্তমানে কোম্পানির কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ রয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। কর অঞ্চল-১-এর সংশ্লিষ্ট সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-কর কমিশনার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই কর অঞ্চলে মাত্র বদলি হয়ে এসেছি। তবে বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম চলছে। পুরো বিষয়টি অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে হচ্ছে।’
এদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে জানা গেছে, একমি পেস্টিসাইডস লিমিটেডের প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের পাঁচজনসহ মোট ১৪ ব্যক্তি ও ছয়টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
বিএসইসি সূত্র জানায়, তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে একমি পেস্টিসাইডসের সংশ্লিষ্টরা চার বিনিয়োগকারীর মধ্যে তিনজন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে শেয়ার ইস্যুর শর্তে প্রায় ১৪ কোটি টাকা গ্রহণ করেন। ওই অর্থের অংশ বিভিন্ন সময়ে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজা-উর রহমান সিনহা, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সেলিম রেজা এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চেক ও নগদের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এর বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের নামে ১ কোটি ১৩ লাখ ৯৪ হাজার ৩২৯টি (বোনাস শেয়ারসহ) শেয়ার ইস্যু করা হয়, যার মূল্য নির্ধারিত হয় ১১ কোটি ৩৯ লাখ ৪৩ হাজার ২৯০ টাকা। অর্থাৎ, কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেশি নিয়েছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।

