** ঘোষণা বর্হিভূত আমদানি করা ওষুধের কাঁচামাল বাজেয়াপ্ত, ২.৯৪ কোটি টাকা জরিমানা
** প্রতিষ্ঠান বলছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গুদাম থেকে ভুলে ওষুধের কাঁচামাল দিয়ে দিয়েছে
** ঘোষণা বর্হিভূত ৩৭ ধরনের ১৫ হাজার ৯৭৫ কেজি ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে
** ৫৮০৫ কেজি ভায়াগ্রা দিয়ে ২৫ মিলি গ্রামের ২৩ কোটি, ৫০ মিলি গ্রামের ১১ কোটি ও ১০০ মিলি গ্রামের ৫.৮০ কোটি ট্যাবলেট বানানো সম্ভব
** দেশের সর্ববৃহৎ ভায়াগ্রার চালান বেনাপোলের পর হিলি শুল্ক স্টেশনে আটক হয়েছে
আমদানির ঘোষণা ছিলো চায়না ক্লে পাউডার (রাবার গ্রেড) বা কাওলিনিকে ক্লে। এক বা দুই বস্তা নয়, এক হাজার ১১৪ বস্তায় ভারত থেকে ঘোষণা অনুযায়ী চায়না ক্লে আমদানিও হয়েছে। সব বস্তার উপরে চায়না ক্লে লেখাও রয়েছে। কিন্তু চায়না ক্লে’র মধ্যে বিশেষ কায়দায় আমদানি হয়েছে ঘোষণা বর্হিভূত ওষুধের কাঁচামাল। তাও আবার এক বা দুই কেজি নয়, প্রায় ১৬ হাজার কেজি। এখানে শেষ নয়, ৩৭ ধরনের ওষুধের এই কাঁচামালের মধ্যে আমদানি হয়েছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আমদানি নিয়ন্ত্রিত ৫ হাজার ৮০৫ কেজি সিলডেনাফিল সাইট্রেট, যা ভায়াগ্রা নামে পরিচিত। ভায়াগ্রা এক ধরনের মাদক। এই বিপুল পরিমাণ ভায়াগ্রা দেশে প্রবেশ করলে তা দিয়ে বিপুল পরিমাণ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর যৌন উত্তেজক ওষুধ তৈরি হতো।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৯ সালে বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ভায়াগ্রা চালান আমদানি হয়েছে, যা কাস্টমস আটক করে। যার মাধ্যমে তৎকালীন কাস্টমস কর্মকর্তারা চোরাচালানিদের রোষানলে পড়েন। তবে সে সময় মাত্র ২ হাজার ৫০০ কেজি ভায়াগ্রা আটক হয়েছিল, যা দেশে সর্ববৃহৎ ভায়াগ্রা চালান আটক ছিলো। হিলি শুল্ক স্টেশনে আটক হয়েছে ৫ হাজার ৮০৫ কেজি, যা দেশে এটিই সর্ববৃহৎ ভায়াগ্রার চালান।
রংপুর ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন হিলি স্থলবন্দরে চায়না ক্লে ঘোষণায় আমদানি করা এই বিপুল পরিমাণ ওষুধের কাঁচামাল ও ভায়াগ্রা আটক করেছে ভ্যাট কর্মকর্তারা। তবে কর্মকর্তাদের তৎপরতার কারণে মিথ্যা ঘোষণার এই পণ্য চালান আটক হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণা দেওয়ায় এবং আমদানি নীতি লঙ্ঘন করায় ইতোমধ্যে ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান উজালা পেইন্ট ট্রেডিং কোং-কে প্রায় তিন কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে ঘোষণা বর্হিভূত পণ্য রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, চায়না ক্লে পাউডার মূলত সিরামিক, কাগজ এবং রঙ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রসাধনী যেমন ফেস প্যাক, সাবান ও মাস্ক তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। কারণ এটি ত্বকের তেল শোষণ করে এবং ত্বক পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এছাড়াও চায়না ক্লে পাউডার টুথপেস্ট, ওষুধ এবং অন্যান্য অনেক পণ্যেও ব্যবহার করা হয়।
এনবিআর সূত্রমতে, রাজধানীর দনিয়া কদমতলী এলাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান উজালা পেইন্ট ট্রেডিং কোং। প্রতিষ্ঠানটি ১ আগস্ট চায়না ক্লে পাউডার (রাবার গ্রেড) বা কাওলিনিকে ক্লে ঘোষণায় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে একটি পণ্য চালান আমদানি করে। ৭ আগস্ট সিঅ্যান্ডএফ বাবুল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। কিন্তু ঘোষণা বর্হিভূত পণ্য আমদানি হয়েছে এমন তথ্য থাকায় হিলি স্থল কাস্টমস স্টেশনের কর্মকর্তারা চালানটি আটক করে। পরে কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, চালানটিতে ১ হাজার ১১৪ বস্তা ৩০ হাজার ২৪৫ কেজি পণ্য রয়েছে। প্রতিটি বস্তার গায়ে ‘চায়না ক্লে পাউডার (রাবার গ্রেড)’ লেখা রয়েছে। পরে বস্তাগুলো খোলা হলে চায়না ক্লে’র ভেতরে একাধিক ছোট ছোট প্যাকেট পাওয়া যায়। তবে যেসব বস্তার মধ্যে প্যাকেট পাওয়া যায় সে সব বস্তার উপরে বিভিন্ন রকম সাংকেতিক চিহৃ ব্যবহার করা হয়েছে। আবার এসব বস্তার মধ্যে একই রং ও বর্ণের পণ্য পাওয়া গেছে, যা চায়না ক্লে নয়। পরে ৭৩টি নমুনা সংগ্রহ করে কাস্টমস কর্মকর্তারা পরীক্ষার জন্য খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) প্রেরণ করেন। ২৬ আগস্ট কুয়েট থেকে রিপোর্ট দিয়েছে।
কায়িক পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমদানি করা ৩৮ ধরনের কাঁচামাল রয়েছে, যার গ্রস ওজন ৩০ হাজার ৬৮৮ কেজি, আর নেট ওজন ৩০ হাজার ২৮৫ কেজি। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩১০ কেজি চায়না ক্লে। বাকি ১৫ হাজার ৯৭৫ কেজি ওষুধের কাঁচামাল। আবার ৩৭ ধরনের ওষুধের মধ্যে ৫ হাজার ৮০৫ কেজি সিলডেনাফিল সাইট্রেট বা ভায়াগ্রা। অন্যান্য কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে-৪২৫ কেজি সেটিরিজিন ডাই-হাইক্লোরাইড, ১৩২৫ কেজি ক্লোরফেনিরামিন ম্যালেট, ১০০ কেজি অ্যালজিনিক এসিড, ২ কেজি সিট্রাল, ৪৭ কেজি ক্যাফিন, ২২৫ কেজি সাইট্রিক এসিড, ৪২৫০ কেজি ওমেপ্রাজল, ২০৫ কেজি ডিএল-অ্যালানাইন, ১৭৬ কেজি সাইপ্রোহেপ্টাডিন হাইড্রোক্লোরাইড, ১৫০ কেজি এরিথ্রোমাইসিন, ২০ কেজি পলিঅ্যাক্রিলেট, ২৫০ কেজি সেলুলোজ, ১০০ কেজি রেসোরসিনল, ৫০ কেজি সাইপ্রোহেপ্টাডিন, ২৫ কেজি সিপ্রোফ্লক্সাসিন হাইড্রোক্লোরাইড, ৭৫ কেজি ডমপেরিডন, ২৫০ কেজি সিস্টাইন ডেরিভেটিভস মেডিসিন, ২৫ কেজি সোডিয়াম পিকোসালফেট, ২৩ কেজি মেলিট্রেসেন হাইড্রোক্লোরাইড, ১২৫ কেজি সোডিয়াম স্টার্চ গ্লাইকোলেট, ৩০০ কেজি কার্বক্সিমিথাইল সেলুলোজ, ৬৫০ কেজি ফেক্সোপেনাডিন হাইড্রোক্লোরাইড, ২০০ কেজি পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৩৬ কেজি ডেক্সামেথাসোন, ২৫ কেজি সালবুটামল সালফাইট, ৭৫ কেজি ফ্লুক্লোক্সাসিলিন সোডিয়াম, ৩০০ কেজি প্রিপারজিন সাইট্রেট, ১০০ কেজি প্রো-মিথাজিন হাইড্রোক্লোরাইড, ২৮ কেজি সোডিয়াম স্টার্চ গ্লাইকোলেট, ২ কেজি লেভোফ্লক্সাসিন, ৩০০ কেজি লিডোকেইন হাইড্রোক্লোরাইড, ২০ কেজি অ্যাসিক্লোফেনাক, ২০০ কেজি অ্যাটেনোলল, ১৭৫ কেজি ক্লোরডায়াজেপক্সাইড, ১ কেজি প্রেডনিসোলন, ৫ কেজি ট্রেটিনয়েন।
সূত্রমতে, ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নীতি আদেশ, ২০২১-২০২৪ অনুযায়ী ব্লক লিস্ট পণ্য, যা আমদানি করতে হলে ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। আমদানিকারক অনুমতি ব্যতীত ওষুধের কাঁচামাল এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সিলডেনাফিল সাইট্রেট বা ভায়াগ্রা আমদানি করেছে। আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য চালানের প্রযোজ্য শুল্ককর ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩২৫ টাকা। তবে সঠিক এইচএস কোড অনুযায়ী আমদানি করা পণ্যের প্রযোজ্য শুল্ককর ১ কোটি ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৯৭৩ টাকা। অসত্য ঘোষণায় প্রতিষ্ঠানটি ১ কোটি ৪৭ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৭ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
সূত্র আরও জানায়, ঘোষণা বর্হিভূত এবং অনুমতি ব্যতীত ওষুধের কাঁচামাল, জনস্বাস্থ্যের জন্য ভায়াগ্রা আমদানি করায় প্রতিষ্ঠানকে ২১ সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠান ৬ অক্টোবর নোটিশের জবাব দেয়। যাতে ‘ভারতের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাদের গুদাম থেকে ভুলে ওষুধের কাঁচামাল চায়না ক্লের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করে’। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজ ইচ্ছায় আনেনি বলে জানায়। তবে ওষুধের কাঁচামাল ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ভায়াগ্রা আমদানিতে আমদানিকারক কোনভাবে দায় এড়াতে পারে না। ১৪ অক্টোবর বিচারাদেশ দেওয়া হয়। যাতে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চালানটি (ওষুধের কাঁচামাল) রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে আমদানি করা চায়না ক্লে’র শুল্ককর পরিশোধ সাপেক্ষে বাজেয়াপ্তের পরিবর্তে এক লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা ও প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যক্তিগত জরিমানা আরোপ করা হয়।
সূত্রমতে, সিলডেনাফিল সাইট্রেট হচ্ছে ভায়াগ্রার সক্রিয় উপাদান। যা সাধারণত ২৫ মিলি গ্রাম, ৫০ মিলি গ্রাম ও ১০০ মিলি গ্রাম ডোজে ট্যাবলেট আকারে বিক্রি হয়। সে হিসেবে, এক কেজি সমান ১ হাজার গ্রাম। এক হাজার গ্রাম সমান ১০ লাখ মিলি গ্রাম। ২৫ মিলি গ্রাম ট্যাবলেট হলে এক কেজি ভায়াগ্রা দিয়ে ৪০ হাজার ভায়াগ্রা বানানো সম্ভব। একইভাবে এক কেজি ভায়াগ্রা দিয়ে ৫০ গ্রামের ২০ হাজার ও ১০০ গ্রামের ১০ হাজার ট্যাবলেট বানানো সম্ভব। হিসাব অনুযায়ী, ৫ হাজার ৮০৫ গ্রাম ভায়াগ্রা দিয়ে ২৫ মিলি গ্রামের ২৩ কোটি ২২ লাখ ট্যাবলেট বানানো সম্ভব। একইভাবে ৫০ মিলি গ্রামের ১১ কোটি ৬১ হাজার ও ১০০ মিলি গ্রামের ৫ কোটি ৮০ লাখ ট্যাবলেট বানানো সম্ভব।
** বেনাপোলে দেশের সর্ববৃহৎ আড়াই টন ভায়াগ্রা আটক
** বেনাপোল কাস্টমসে আড়াই টন ভায়াগ্রা পাউডার উদ্ধার

