দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গত এক বছরে চট্টগ্রামে প্রায় ২২টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে কয়েক হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, আর্থিক সংকট, এলসি জটিলতা এবং অর্ডার কমে যাওয়াসহ নানা কারণে এসব কারখানা বন্ধ হয়েছে। শিল্প পুলিশের তালিকা অনুযায়ী, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম ইপিজেডসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্ধ হওয়া ২২টি কারখানার মধ্যে এ বছরের শুরু থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ১১টি কারখানা কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এসব কারখানায় কর্মরত ছিলেন ৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক।
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন বলেন, বন্ধ হওয়া বেশিরভাগ কারখানার শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়েছে মালিকপক্ষ। শিল্প পুলিশের হিসাবে ২২টি কারখানা বন্ধ হলেও সংখ্যাটা আরও বেশি বলে মনে করেন অনেকে। কারণ চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা ছোট ছোট অনেক কারখানা বড় কারখানাগুলো থেকে কাজ নিয়ে করে থাকে। কাজ না পেয়ে সেগুলোরও অনেক বন্ধ হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণেও কিছু কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে নগরীতে।
সবশেষ গত ১৪ ও ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম ইপিজেডে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হয়। সে কারণে গ্রুপটি তাদের আটটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। তবে সেগুলো বৃহস্পতিবার থেকে পুনরায় কাজ শুরু করেছে। এক বছরে চট্টগ্রামের ৭০টি কারখানায় ৩১৫ বার শ্রমিক অসন্তোষের মত ঘটনা ঘটেছে বলেও শিল্প পুলিশের তথ্য বলছে। পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র হিসাবে, চট্টগ্রামে তাদের সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৬৯৯টি। এর মধ্যে সচল ৬১০টি, তবে বর্তমানে চালু আছে ৩৪৮টি কারখানা।
বন্ধ হওয়া ২২ পোশাক কারখানার মধ্যে চট্টগ্রাম ইপিজেডে রয়েছে চারটি, যেগুলো গত পাঁচ মাসে বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যে রয়েছে নাসা গ্রুপের মালিকানাধীন টয় উড (বিডি) কোম্পানি লিমিটেড ও এমএনসি অ্যাপারেলস লিমিটেড। অপর দুইটি প্রতিষ্ঠান হলো থিয়নিস অ্যাপারেলস লিমিটেড ও জেএমএস গার্মেন্টস লিমিটেড। ইপিজেডের এসব কারখানায় মোট ৪ হাজার ৮১৮ জন শ্রমিক কাজ করতেন। বাকিগুলোতে আরও ৪ হাজারের মত শ্রমিক কাজ হারিয়েছে।
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশ বন্ধ কারখানার যে তালিকা করেছে, তার মধ্যে চট্টগ্রাম ইপিজেডের থিয়নিস অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানাটি বন্ধের কারণ হিসেবে মালিকের আর্থিক সংকট ও এলসি জটিলতার কথা বলেছে। আর্থিক সংকটে জেএমএস গার্মেন্টস লিমিটেডও বন্ধও হয়েছে। নাসা গ্রুপের দুটি কারখানা বন্ধের কারণ হিসেবে ব্যাংক জটিলতা, আর্থিক সংকট ও কাজের অর্ডার না থাকার কথা বলছে শিল্প পুলিশ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের ২ অক্টোবর ঢাকার গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হন নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ বেশ কিছু মামলা হয়েছে।
কারখানা বন্ধের বিষয়ে বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানা টিকিয়ে রাখা ‘অনেক কঠিন’। খুব স্ট্রং কমপ্লায়ান্স ফ্যাক্টরি না হলে টিকে থাকা কষ্টের। বায়িং হাউসের মাধ্যমে যেসব ফ্যাক্টরি চলছিল তারা কোনোভাবে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। তার ওপর মার্কিন ট্যারিফ ঘোষণার পর অনেক অর্ডার কমে গেছে, দাম কমে গেছে…। সব মিলিয়ে একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছে এ খাত। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূরক শুল্কারোপের পর চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় বেশি প্রভাব পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে আমেরিকার পণ্য বেশি তৈরি হয়। নতুন মার্কিন ট্যারিফের কারণে লাভটা আসে না। যার কারণে ব্যবসায় টিকে থাকাটা অসম্ভব। সব মিলিয়ে বড় বড় কমপ্লায়েন্ট ফ্যাক্টরিগুলো টিকে থাকলেও ছোটগুলো টিকে থাকতে পারছে না। বিজিএমইএ নেতা আবু তৈয়বের ভাষ্য, কারখানা মালিকরা কঠিন সংকটে। অর্ডার না থাকায় কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এ বছর সংকট থেকে উন্নতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আগামীতে যদি বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে, তাহলে পোশাক কারখানা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

