বিশ্বের বহু দেশ এখন নগদবিহীন বা ক্যাশলেস লেনদেন ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এই ব্যবস্থার সুবিধার মধ্যে রয়েছে সহজলভ্যতা ও সময় সাশ্রয়, তবে এর সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও স্বচ্ছতার বিষয়ও জড়িত। বাংলাদেশে নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খরচ; প্রতি বছর টাকা ছাপানো থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদবিহীন লেনদেন কার্যকর করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন জেলায় মানুষকে ক্যাশলেস লেনদেনে উৎসাহিত করতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু বা নবায়নের সময় কিউআর কোডে পেমেন্ট নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নগদ লেনদেন কমানোর ক্ষেত্রে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে আছে। এই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা দেখায়, শুরুতে তারা নগদবিহীন লেনদেনকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করেছে, যা মার্চেন্ট ও গ্রাহক উভয়কে আগ্রহী করেছে। একই সঙ্গে নগদ লেনদেনে অতিরিক্ত চার্জ, কর বা শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং ঝুঁকি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। এর ফলে একটি কার্যকর ক্যাশলেস সমাজ গড়ে উঠেছে, যার সুফল হিসেবে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়ে যায়। বাংলাদেশে আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা ক্যাশলেস লেনদেন নিয়ে প্রচার থাকলেও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বা কিছু ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার কারণে সফলতা সীমিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩০ লাখ। এর মধ্যে ১২ কোটি ৯০ লাখের বয়স ১৫ বছরের বেশি। আর চার কোটি ৪০ লাখ ১৪ বছর পর্যন্ত বয়সী। দেশে এখন ১৮ কোটি ৬০ লাখ মোবাইল সংযোগ রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৯০ লাখ। ৯ কোটি ৩০ লাখ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী রয়েছে। যারা ডিজিটাল লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিগত দশকে ডিজিটাল লেনদেন অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে ডিজিটাল লেনদেন বেড়েছে। আরটিজিএস, এনপিএসবি, বিইএফটিএনের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এখন প্রচুর লেনদেন হচ্ছে। বর্তমানে আর্থিক মূল্যের দিক থেকে ৩০ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে ডিজিটালি। আর সংখ্যায় ৪৯ শতাংশ। তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনও হচ্ছে। এরপরও প্রতিবছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে নগদ টাকার চাহিদা বাড়ছে। এর পেছনে মূল কারণ লেনদেনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো পর্যায়ে নগদ টাকার ব্যবহার হচ্ছে। অভ্যাসগত বিষয়ের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার কেনাকাটায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চাইলেও অনেকে ডিজিটাল পরিশোধ করতে পারছে না। ইকো সিস্টেম ডিজিটাল না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপানো, পুরোনো টাকা পোড়ানো এবং ব্যাংকগুলোর নগদ লেনদেন ব্যবস্থাপনার পেছনে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, যা দেশের অনেক বড় প্রকল্পের মোট খরচের চেয়ে কম।
ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার উদ্যোগ
একজন ব্যক্তি ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্টে টাকা যাওয়ার পর বেশির ভাগ খরচ যেন ডিজিটালি করতে পারে সে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে শহর কিংবা গ্রামে কেউ চাইলেও ডিজিটাল পেমেন্ট করতে পারে না। এটা সহজ করতে ব্যাংক ও এমএফএসের কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেনের জন্য বাংলা কিউআরে পরিশোধ বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে এরই মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের ক্ষেত্রে বাংলা কিউআর কোডে পরিশোধ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক লেনদেন সহজ করতে বিল গেটস ফাউন্ডেশনের ‘মোজোলুপ’ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থা চালু হলে বিকাশ, নগদের মতো এক এমএফএস কোম্পানি থেকে আরেক এমএফএস কোম্পানিসহ ব্যাংক, এমএফএসে সহজে লেনদেন করা যাবে। বর্তমানে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে সহজে টাকা পাঠানো গেলেও এক এমএফএস থেকে আরেক এমএফএসে টাকা পাঠানো যায় না। ডিজিটাল পেমেন্টের জন্য অ্যাপে নিবন্ধন করতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকের মোট ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ গ্রাহক মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করছেন, যা এখনও অনেক। আর এমএফএস গ্রাহকদের ৭৫ শতাংশ মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেন। অ্যাপের ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আসছে ডিজিটাল ব্যাংক
ডিজিটাল ইকো সিস্টেমের অংশ হিসেবে সত্যিকারের ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য আগ্রহীদের থেকে গত আগস্টে আবেদন চাওয়া হয়েছে। এ রকম একটি ব্যাংক করার জন্য প্রযুক্তি সক্ষমতা ছাড়াও ৩০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন লাগবে। এর আগে ২০২৩ সালে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ছিল রাজনৈতিক। যে কারণে সেই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি। ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবেদন চাওয়ার পর ৫২টি আবেদন পড়েছিল। তবে শুধু নগদ ডিজিটাল ব্যাংক ও কড়ি ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন দেখা যাচ্ছে দুটি প্রতিষ্ঠানে যেসব বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে, তা মূলত বাংলাদেশিদের শেল কোম্পানি।
ডিজিটাল ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ সবই হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। গ্রাহকদের জন্য শুধু ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড বা অন্য কোনো অগ্রসর প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য ইস্যু করতে পারবে এসব ব্যাংক। প্রচলিত ব্যাংকের মতো এসব ব্যাংকের নিজস্ব শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনো ধরনের ব্যবসা কেন্দ্র থাকবে না। সব আবেদনই হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। তবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও সাপোর্ট স্টাফদের বসা এবং গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির জন্য একটি প্রধান কার্যালয় থাকবে। গ্রাহকদের ডেলিভারি চ্যানেল হিসেবে অন্য ব্যাংক বা এমএফএস এজেন্ট, এটিএমসহ এ জাতীয় নেটওয়ার্ক এবং এমএফএস নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে লেনদেন করতে পারবেন। ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঋণ দেওয়ার জন্য ক্রেডিট স্কোরিংও করতে হবে অনলাইনে। যে কারণে বেসরকারি খাতের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাইভেট ক্রেডিট ব্যুরোর অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংক বিভিন্ন গ্রাহকের বিভিন্ন লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করে স্বয়ংক্রিয় ক্রেডিট স্কোরিং করবে। এই ক্রেডিট ব্যুরোতে ছোট ছোট ঋণের জন্য টেলকো, এমএফএস, ব্যাংক সব জায়গার সমন্বিত ডাটাবেজ থাকবে।
বাংলা কিউআরে আগ্রহ বাড়াতে প্রচারণা
খুচরা লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বাংলা কিউআর’ নামে জাতীয় কিউআর কোড স্ট্যান্ডার্ড চালু করে বছর দুয়েক আগে। এই কিউআর ব্যবহার করে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক লেনদেন করতে পারবেন। বর্তমানে ৪৩টি ব্যাংক, পাঁচটি এমএফএস এবং তিনটি পিএসপি এ ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সাত লাখ ২০ হাজার মার্চেন্ট পয়েন্টে এ ব্যবস্থা রয়েছে। এখন সারাদেশে এটি ছড়িয়ে দিতে প্রচারণা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নগদহীন লেনদেন উদ্যোগ সম্প্রসারণের জন্য ছয় মাসের একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। জনসচেতনতা বাড়াতে ঢাকার বাইরে ২০টি জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। রাজধানীর মতিঝিলে
বাংলা কিউআর কোডভিত্তিক লেনদেনের
পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করা হয় ২০২৩ সালে। ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন বাজার, বাংলা কিউআর পেমেন্ট সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, সরকারি ইউটিলিটি বিল, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ভাতাসহ খুচরা ব্যবসার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতকে এ উদ্যোগের আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

