** নিয়মে না থাকলেও সরকারি প্লট পরিবর্তন
** বন্ধুর নামে প্লট নিয়ে নিজে আমমোক্তার
** মুক্তিযোদ্ধা সনদও প্রশ্নবিদ্ধ
কালো টাকা সাদা করেছেন শ ম রেজাউল করিম। বর্তমানে তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী। ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে ৬৬ লাখ টাকা সাদা করেছেন তিনি। তার আয়কর নথিতে এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তিনি এই টাকা সাদা করেন। নথির তথ্যমতে, শ ম রেজাউল করিম মন্ত্রী হওয়ার আগেই কালো টাকা সাদা করেছেন। দুর্নীতিবিরোধী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো জনপ্রতিনিধি কালো টাকা সাদা করলে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে- তিনি কালো টাকার মালিক কেন? তাই এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া তিনি যে কোনো সময়ই কালো টাকা সাদা করুন না কেন, তিনি আইন অনুযায়ী জবাবদিহির আওতায় আসবেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, আয়কর আইনে যেহেতু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেহেতু যে কোনো ব্যক্তি কালো টাকা সাদা করতে পারেন। কিন্তু একজন জনপ্রতিনিধি কালো টাকা সাদা করলে তার মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জনপ্রতিনিধিরা আইন প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত। তারা মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এবং অনুকরণীয়। এসব ক্ষেত্রে কারও ঘাটতি দেখা দিলে জনগণের মধ্যে তার সততা (ইন্টেগ্রিটি) নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যক্তি কালো টাকা সাদা করে সম্পদ অর্জন করলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবশ্যই ওই সম্পদের অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইতে পারবে যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তির টাকার উৎস সম্পর্কে জানার ক্ষমতা দুদকের আছে সম্পদ অবৈধ হলে দুদক আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
শ ম রেজাউল করিম পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদসা। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ওই দিন তাকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় বর্তমানে তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। পূর্ত মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় বিভিন্ন অভিযোগে তিনি আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। এখন সাফারি পার্ক ও চিড়িয়াখানায় প্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাতেও তিনি আলোচনায় এসেছেন।
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে আইনে যা আছে, আমরা তা-ই করব। সে যে কেউ হোক না কেন, আইনের আওতায় আসবে। আইনের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’ তবে কালো টাকা সাদা করার অভিযোগটি সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আমি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ছিলাম। আমি যখন যা আয় করেছি, আমার আয়ের টাকা ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে দেওয়া আছে। এক টাকাও হেরফের করা হয়নি’। মন্ত্রীর ভাষ্য, ‘আমি শতভাগ সৎমানুষ ইনশাআল্লাহ। একজন মন্ত্রী হিসেবে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি কারও কাছ থেকে ঘুষ নিই না, আমি কোনো কমিশন খাই না, আমি কোনো অনিয়ম করি না তারপরও ভুল হতে পারে।
কালো টাকা সাদা করা ছাড়াও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও কিছু গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের প্লট স্থানান্তর। নিয়ম অনুযায়ী তিনি প্লট পরিবর্তন করতে পারেন না তবু মন্ত্রী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তিনি তা করেছেন। পাশাপাশি একই প্রকল্পে তার এক ‘বন্ধুর’ নামে একটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন তিনি সেই প্লটের আমমোক্তার হয়েছেন মন্ত্রী নিজে এবং তার ছোট ভাই এস এম নূর আলম সিদ্দিকী। এই ভাই বর্তমানে মন্ত্রীর পিএ হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
এ ছাড়া অনুসন্ধানে মন্ত্রীর বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তার বিষয়ে পাওয়া বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মন্ত্রী হওয়ার এক মাস দুই দিন পর ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শ ম রেজাউল করিম উত্তরায় রাজউকের তৃতীয় পর্বের প্রকল্পের ১৬/বি নম্বর ব্লকের ৩/এ নম্বর রোডের ২০ নম্বর প্লটটি পরিবর্তন করে ৭ নম্বর সেক্টরে ২. নম্বর রোডে পাঁচ কাঠার ১৩ নম্বর প্লট নেন। যদিও এর বেশ আগেই ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই রাজউক চেয়ারম্যানকে দেওয়া চিঠিতে বরাদ্দকৃত প্লটের আইডি পরিবর্তন না করার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই আদেশ বহাল থাকার পরও শ ম রেজাউল করিমের প্লটটি পরিবর্তন করা হয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রী প্রভাব খাটিয়ে এ কাজ করেছেন।
নথিপত্রে দেখা যায়, শ ম রেজাউল করিম গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী হওয়ার পাঁচ মাস পর তার জনৈক বন্ধু সুখরঞ্জন বেপারীকে উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের ১০০ কাঠার প্লট পাইয়ে দেন। সুখরঞ্জনের প্লটের আবেদনে মন্ত্রী রাজউক চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে স্বহস্তে লিখে ১৩/এ ধারায় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এই ধারায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যক্তির নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, অখ্যাত সুখরঞ্জন বেপারীর নামে ওই ধারায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে মন্ত্রী দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অনেক চেষ্টা করেও মন্ত্রীর এই ‘বন্ধু’র বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে তার সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রী পর্যায়ের কারও কালো টাকার মালিক হওয়ার নজির থাকা কতখানি যে অনৈতিক, সরকারের এই মন্ত্রী তারই দৃষ্টান্ত। কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার পেছনে অধিকাংশ ক্ষমতাবান মানুষের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- এ ঘটনায় এটাই প্রতীয়মান হয়। ঢাকায় বাড়ির মালিক হয়েও মন্ত্রীর নামে সরকারি প্লট বরাদ্দ, আবার সেটি স্থানান্তর এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের মালিক হওয়া নৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। তিনি প্রতারণামূলক প্রক্রিয়ায় প্লট স্থানান্তর করেছেন। এগুলো তদন্ত করে দুদক তাকে জবাবদিহির মধ্যে আনুক।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘ঢাকায় জায়গা থাকা সত্ত্বেও আমি রাজউকের প্লট নিয়েছি- বিষয়টা এমন নয়। বিষয়টা হলো, রাজউকের আইন হচ্ছে- কেউ যদি প্লটের জন্য আবেদন করেন, সেই আবেদনে ঘোষণা দিয়ে বলতে হয় যে তিনি ইতোপূর্বে রাজউক বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো প্লট পাননি। একজনের দশটা জায়গা থাকলেও রাজউকের প্লট পাওয়ার অযোগ্য হবেন না। সরকারি কোনো প্লট যদি আপনি যদি নিয়ে থাকেন, তাহলে আবার নিতে পারবেন না।’
আরও তথ্য: ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শ ম রেজাউল করিম তার হলফনামায় বার্ষিক আয় দেখান ৭৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা, আর বার্ষিক ব্যয় ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯২ টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী তার বার্ষিক সঞ্চয় ২৬ লাখ ২৩ হাজার ৫০৮ টাকা। নগদ ও ব্যাংক মিলিয়ে ওই সময় তার কাছে ছিল এক কোটি ৩২ লাখ টাকা। গত চার বছর তার এই হারে আয় হলে মোট সম্পদ দাঁড়ায় দুই কোটি ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। কিন্তু বিভিন্ন নথিপত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে বহু গুণ বেশি। শ. ম রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি তদন্ত সংস্থায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের নথিতে দেখা যায়, এ মন্ত্রীর নামে ঢাকার বাড্ডা পুনর্বাসন এলাকায় রাজউকের অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত বাড্ডা মৌজার ৮৯৪ নম্বর দাগে পূর্ব দিকের ১১ নম্বর সড়কের শেষ প্রান্তে ১০ তলা বাড়ি রয়েছে। বাড়িটির নির্মাণ ব্যয় ১৫ কোটি টাকা।
রাজধানীর তোপখানা রোডের ৩৩ নম্বর ভবনে দুটি অফিস স্পেস, যার মূল্য ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। বাড্ডায় রয়েছে ২.৫০ শতাংশ, ৭.৫৫ ও ৪.৯৫ শতাংশ জমির তিনটি প্লট। এসব ছাড়াও রাজধানীতে ৪ শতাংশ জমিতে একটি বহুতল পাকা বাড়ি রয়েছে, যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। ঢাকার মিরপুরে বড় সায়েক এলাকায় তিন কাঠার একটি প্লটে দেড় কাঠা জমিও কিনেছেন তিনি। মিরপুর পাইকপাড়ায় কেয়ারী বুরুজ ভবনেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর বাইরে পিরোজপুর জেলায় নিজ উপজেলা নাজিরপুর ও আশপাশের এলাকায় কোটি টাকার জমি ক্রয় করেছেন শ ম রেজাউল করিম।
মুক্তিযোদ্ধা বিতর্ক: এ মন্ত্রীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শ ম রেজাউল করিমের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সে হিসেবে ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তার বয়স ছিল ৯ বছর ১ মাস। এর পরও ২০০৫ সালের ১৪ মে প্রকাশিত গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রসঙ্গত, সরকারের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স সাড়ে ১২ বছর। তা ছাড়া ভারতীয় দলিল, লাল মুক্তিবার্তা বা অন্য কোনো গেজেটে শম রেজাউল করিমের নাম নেই বলে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ বিষয়ে শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘এইটা নিয়ে আমি আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। এ দেশের অনেক মানুষের জন্মতারিখ সঠিক থাকে না। তবে এই কথাটা ফরমালি আপনাকে আমার বলা ঠিক হবে না। এটা নিয়ে আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না। এ ছাড়া আমার সম্পর্কে যা যা জানার আছে, প্রশ্ন করেন।’ আপনি একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি আর ইন্টারভিউ ফেস (সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে) করতে চাচ্ছি না। এই প্রশ্নে আমি বিব্রত হচ্ছি।’

