হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে বিভিন্ন আমদানি পণ্যের সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক দ্রব্যও মজুত ছিল। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বাজেয়াপ্ত পুরোনো ও নষ্ট মালামাল স্তূপাকারে পড়ে ছিল বলে জানিয়েছে ঢাকা কাস্টমস। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়। এসব রাসায়নিকের কারণে ক্ষতির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে গত শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে সূত্রপাত হওয়া আগুন প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর গতকাল রোববার পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়েছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি কাজ করে।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে ঠিক কত পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য মজুত আছে, তা নির্ধারণে গত মে মাসে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ঢাকা কাস্টমস। পাঁচ সদস্যের একটি দল এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) ফরিদ উদ্দিন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কমপ্লেক্সটিতে মজুত রাসায়নিক পণ্যের মধ্যে ছিল জিংক ক্লোরাইড—যা ধুলা বা ধোঁয়ার সঙ্গে শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে—এ ছাড়া কেমিক্যাল পাউডার, অতি দাহ্য এভারক্লিয়ার, বিষাক্ত কীটনাশক ক্লোরপাইরিফস, জৈব রঞ্জক রিঅ্যাকটিভ ডাইসসহ আরও বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ। পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যও মজুত ছিল।

সূত্র জানায়, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে আমদানি করা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গেই ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যও রাখা হয়। তবে ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে এসব পণ্যের জন্য পৃথক স্থান নির্ধারণ করার কথা ছিল। কিন্তু পরে তা করা হয়নি। সবশেষ গত ডিসেম্বরেও এমন উদ্যোগ নেওয়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি। উড়োজাহাজ থেকে পণ্য নামানো থেকে শুরু করে আমদানিকারকের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া পর্যন্ত দায়িত্বে থাকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের। পণ্য নামানো, স্ক্যানিং, ওজন, হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ, বিলিং ও ডকুমেন্টেশন—সবই বিমান বাংলাদেশের কাজ। আমদানিকারক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস না করলে প্রতিদিনের জন্য আলাদা ফিও নেয় তারা।
ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশও অবগত। তবে এ বিষয়ে বিমানের কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বিমান বাংলাদেশের একাধিক সূত্র জানায়, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে কোনো পণ্য আসার সঙ্গে সঙ্গে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে মালপত্র বুঝে নিতে হয়। কেউ পণ্য না নিলে ২১ কার্যদিবস পর তা বাজেয়াপ্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। এরপর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তা নিলাম করে। কার্গো কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন ধরে যেসব মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে, সেগুলো নিলাম করে ধ্বংস করা কাস্টমসের আওতাধীন। বিমান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় তাগাদা দেওয়ার পরও কাস্টমস এসব পণ্য নিলাম করেনি।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) অবকাঠামো, নিরাপত্তা ও কার্গো টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা তদারকি করে। এ জন্য বিমানবন্দর ব্যবহার, নিরাপত্তা যাচাই, স্ক্যানিং ও পার্কিং চার্জ নেয় বেবিচক।
ঢাকা কাস্টম হাউসের উপকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে এরপর কী হয়েছে তা জানা নেই। কাস্টমস সূত্র জানায়, এসব সামগ্রী বিপজ্জনক ও আগুন লাগার ঝুঁকি রয়েছে বলে ঢাকা কাস্টম হাউসের পক্ষ থেকে বেবিচককে একাধিকবার জানানো হয়েছিল। এগুলো দ্রুত সরানো না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানানো হলেও দীর্ঘদিন সরানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ বক্তব্য দেননি। রপ্তানিকারকেরা দীর্ঘদিন ধরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লজিস্টিক অদক্ষতা ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো নিয়ে অভিযোগ করছেন। সীমিত স্থান ও অপর্যাপ্ত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থার কারণে পণ্যবাহী বড় উড়োজাহাজের পরিচালনাও সীমিত। রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা, উদাসীনতা এবং অব্যবস্থাপনাই এই বিপর্যয়ের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে।
গত শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে মালামাল খালাসের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় গুদামে মজুত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক, তৈরি পোশাকশিল্পের পণ্য এবং ওষুধশিল্পের কাঁচামাল আগুনে পুড়ে যায়। আমদানি ও রপ্তানিকারকদের দাবি, এই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার কামরুল ইসলাম বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর সঠিক ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
** ক্ষতির পরিমাণ ছাড়াতে পারে হাজার কোটি টাকা
** আগামী ৩ দিন ‘নন শিডিউলড’ ফ্লাইটের খরচ মওকুফ
** অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতি নিরূপণে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন
** শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন
** ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি: বিজিএমইএ

