কারসাজি রোধে প্রতি কেজি শিরিশ কাগজ ৪ ডলারে শুল্কায়ন হবে

** প্রতি কেজি দেড় থেকে আড়াই ডলারে শুল্কায়ন হচ্ছে, সঙ্গে রয়েছে ওজনে কারসাজি ও মিথ্যা ঘোষণা
** চাহিদার ৫০ শতাংশ আমদানি করে সরবরাহ করছে চারটি প্রতিষ্ঠান, দেড় ডলারে খালাস নেয়া হয়েছে
** দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দিতে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন

দেশে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শিরিশ কাগজ বা কাপড়ের বাজার রয়েছে। এই পেপার আমদানিতে কারসাজি করা হচ্ছে। কখনও ওজনে কারসাজি, কখনও কম মূল্য ঘোষণায় আমদানি হচ্ছে। এতে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থপাচার হচ্ছে। কারসাজি ও শুল্ককর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে দেশের একই মালিকাধীন চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। দেশের স্থানীয় বাজারের ৫০ শতাংশ দখলে থাকা এই চারটি প্রতিষ্ঠান দেড় থেকে আড়াই ডলারে প্রতি কেজি শিরিশ কাগজ আমদানি করছে। তবে কারসাজি রোধে প্রতি কেজি শিরিশ কাগজ ৪ ডলারে শুল্কায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। বাজার যাচাই শেষে এই সুপারিশ করেছে কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ কমিশনারেট। সম্প্রতি এনবিআরকে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাউন্ড টেক লিমিটেড নামে একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান দেশে শিরিশ কাগজ উৎপাদন করছে। মিথ্যা ঘোষণা ও ওজনে কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে দেশে শিরিশ কাগজ বা কাপড় আমদানি হচ্ছেÑদেশীয় এই প্রতিষ্ঠান এনবিআরে এমন অভিযোগ করে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটকে নির্দেশ দেয়। এই কমিশনারেট ‘ওরাকল বিজনেস ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার’ ও ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম’ থেকে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আমদানি করা শিরিশ কাগজ আমদানির ডেটা পর্যালোচনা করে। এতে দেখা গেছে, ‘স্যান্ড পেপার বা অ্যাব্রেহেসিভ পেপার’ নামে দেশে শিরিশ কাগজ আমদানি হয়। আমদানি করা শিরিশ কাগজ দেশের বিভিন্ন কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে প্রতি কেজি দেড় থেকে আড়াই ডলারে শুল্কায়ন হচ্ছে। তবে কমিশনারেট থেকে শিরিশ কাগজের ‘সঠিক মূল্য’ নির্ধারণের জন্য বাজারমূল্য যাচাইয়ে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি বাজার যাচাই শেষে ১৮ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। কমিটির সুপারিশসহ প্রতিবেদন এরই মধ্যে এনবিআরে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিটির সদস্যরা ২১ মার্চ ঢাকার নবাবপুর মার্কেটের একাধিক বিক্রয় কেন্দ্রে শিরিশ কাগজের বাজার যাচাই করেছেন। কমিটি সদস্যরা বাজার থেকে বিভিন্ন মূল্যের কয়েক ধরনের শিরিশ কাগজ সংগ্রহ করেন। এতে দেখা গেছে, প্রতিটি শিরিশ কাগজ সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বাজার থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন মানের ১০টি শিরিশ কাগজের ওজন ৩০৫ গ্রাম। আর ১০টি গড় মূল্য দাঁড়ায় ২৭৫ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি শিরিশ কাগজের গড় বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় ৯০০ টাকায়। এক্ষেত্রে পণ্যের বিক্রয় মূল্যকে ভিত্তিমূল্য ধরে শুল্ক মূল্যায়ন (আমদানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ) বিধিমালা, ২০০০-এর বিধি-৭ অনুযায়ী ‘অবরোহী’ পদ্ধতিতে হিসাব করে শুল্কায়নযোগ্য একক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

অবরোহী পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রতি কেজির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য চার ডলার করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই চার ডলার নির্ধারণের ক্ষেত্রে খুচরা বিক্রেতার খরচ ও লাভ, পাইকারি বিক্রেতার খরচ ও লাভ, আমদানিকারকের খরচ ও লাভ, ল্যান্ডিং চার্জ, ইন্স্যুরেন্স, টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স (টিটিআই) ও ডলার মূল্য হিসাব করা হয়েছে। খুচরা বিক্রেতার লাভ ১০ শতাংশ হিসেবে প্রতি কেজির মূল্য ৯০০ টাকা। খুচরা বিক্রেতার খরচ ১০ শতাংশ হিসেবে প্রতি কেজির মূল্য ৮১৮ টাকা। পাইকারি বিক্রেতার খরচ ও লাভ ১০ শতাংশ হিসেবে প্রতি কেজির মূল্য ৭৪৩ টাকা ৮০ পয়সা। আমদানিকারকের খরচ ও লাভ ১০ শতাংশ হিসেবে প্রতি কেজির মূল্য ৬৭৬ টাকা। ল্যান্ডিং চার্জসহ প্রতি কেজির মূল্য ৬১৪ টাকা ৭১ পয়সা, ইন্স্যুরেন্সসহ প্রতি কেজির মূল্য ৬০৮ টাকা ৬৩ পয়সা। ৩৭ শতাংশ হারে শুল্ককরসহ প্রতি কেজির মূল্য ৬০২ টাকা। প্রতি ডলারের মূল্য ১১০ টাকা (মার্চ)। এই পদ্ধতি অনুযায়ী হিসাব করে প্রতি কেজি শিরিশ কাগজের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য চার ডলার করার সুপারিশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। অন্যদিকে ট্যারিফ কমিশনও বাজার যাচাই করে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আমদানি করার প্রমাণ পেয়েছে। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিতে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করতে এনবিআরকে সুপারিশ করেছে।

এ বিষয়ে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে বলেন, প্রতিবেদন বিবেচনায় নেবে এনবিআর। এতে শুল্ককর বাড়বে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা পাবে।
470598730 988617769750029 7575320493437416357 n
অন্যদিকে এনবিআররে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, দেশে তিনটি এইচএস কোডে শিরিশ কাগজ বা কাপড় আমদানি হচ্ছে। আমদানির বেশিরভাগই মিথ্যা ঘোষণা বা ওজনে কম দেখিয়ে আমদানি হচ্ছে। এতে একদিকে শুল্ককর ফাঁকি হচ্ছে, অন্যদিকে দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে। দেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় শিরিশ পণ্যের ব্র্যান্ড জার্মানির ক্লিংস্পোর। দেশের বাজারে ৫০ শতাংশের বেশি এই কোম্পানির দখলে। বর্তমানে দেশে শিরিশ কাগজের বাজার প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। পোল্যান্ডে তৈরি এই পণ্যটি ২০২২ সালের মে ও জুনে এ টু জেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে দুটি চালান আমদানি করে। প্রতি কেজি শুল্কায়ন হয় ১১ দশমিক ২৯ ডলার ও ১০ দশমিক ৭৭ ডলারে।

একই সময়ে ইউনিক করপোরেশন নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর থেকে ক্লিংস্পোরের একই পণ্য আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানটি মাত্র দেড় ডলারে শুল্কায়ন করে। এই প্রতিষ্ঠান ওই বছর আরও কয়েকটি চালান আমদানি করে দেড় ডলারে শুল্কায়ন করে খালাস নিয়েছে। শুধু ইউনিক করপোরেশন নয়, সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা একই পণ্য দেড় ডলারে খালাস নিয়েছে ইউনাইটেড করপোরেশন, কেএলএস লজিস্টিকস ও ক্যাপিটাল করপোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো একই মালিকাধীন। চারটি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে ৪০ কনটেইনার শিরিশ কাগজ আমদানি করেছে। প্রতি কনটেইনারে সর্বনিম্ন ৩০ টন থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার ৮০০ কেজি শিরিশ কাগজ ছিল, যা দেড় ডলারে শুল্কায়ন করে খালাস নেয়া হয়েছে। শুধু মূল্য নয়, শিরিশ কাগজের গ্রেড নির্ভর করে বালির গ্রেডের ওপর। আমদানির ক্ষেত্রে সেই ওজনের কারসাজিও করে আসছে চারটি প্রতিষ্ঠান।

** সিরিশ কাগজের দেশীয় কোম্পানিতে নজর নেই
** দেশীয় সিরিশ কাগজ শিল্প সম্প্রসারণে নীতিসহায়তা দিন

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!