Header – Before
Header – After

কলকাতা-অস্ট্রেলিয়ায় দিলীপের ৬ জুয়েলারি শোরুম

বিতর্কিত স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বিপুল অর্থ পাচারের মাধ্যমে কলকাতা ও অস্ট্রেলিয়ায় ছয়টি জুয়েলারি শোরুম প্রতিষ্ঠা করেছেন। সস্ত্রীক দিলীপের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা থাকলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব বিদেশি সম্পদের খোঁজ নেয়নি। ফলে দুদকের মামলাকে দায়সারাভাবে নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা উল্লেখ করেন। সম্প্রতি দ্রুত জামিন, অগোপন কারামুক্তি এবং দেশত্যাগ সংক্রান্ত খবরের কারণে ‘রহস্যময়’ চরিত্র হিসেবে আবারও আলোচনায় এসেছে দিলীপ।

জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ও তার স্ত্রী সবিতা আগরওয়ালার বিরুদ্ধে গত ৮ অক্টোবর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নতুন কোনো তথ্য থাকলে মামলার তদন্তকালে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। যদি বিদেশে তার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায় তা মামলার অভিযোগপত্রে সংযুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জ্যাঠা পান্না আগরওয়ালার সঙ্গে যুক্ত হয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় আসেন দিলীপ কুমার আগরওয়ালা এবং দুই দশকের মধ্যে ধনকুবের হিসেবে পরিচিত হন। ‘রহস্যময়’ চরিত্রের এই ব্যবসায়ীর দরবারে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের ভিড় ছিল। তিনি আওয়ামী লীগের বাণিজ্য উপকমিটিতেও পদ পান। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় তিনি স্বর্ণের চোরাচালান এবং নকল ডায়মন্ডের ব্যবসা অবাধে চালিয়ে যান। ২০০৬ সালে গুলশানের ইউনিয়ন টাওয়ারে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড শোরুমে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নকল ডায়মন্ড জব্দ করেছিল। পুলিশি তদন্ত হলেও অবৈধ প্রভাব ব্যবহার করে দিলীপ এই মামলার ধারা থেকে মুক্ত থাকেন। এরপর আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে তিনি স্বর্ণ ও ডায়মন্ড জগতের অঘোষিত ডন হিসেবে পরিচিত হন। তিনি বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস)-এর সাধারণ সম্পাদক পদেও বসেন এবং সম্পদ ধনী হয়ে ওঠে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, দিলীপ কুমার আগরওয়ালা কলকাতায় পাঁচটি এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি জুয়েলারি শোরুম চালু করেছেন। এই বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কলকাতার শোরুমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি পান্না ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড পার্ক স্ট্রিটের কামেক স্কয়ারের প্রথমতলায় অবস্থিত। দ্বিতীয়টি ২৫৩, রবীন্দ্র সরণির তৃতীয়তলায়, মাতৃমঙ্গল হাসপাতালের বিপরীতে। তৃতীয় শোরুম ৫১, বিবেকানন্দ রোডের বড় বাজার মার্কেটে, চতুর্থটি ধর্মতলায়, ফায়ার ব্রিজ সদর দপ্তর সংলগ্ন ৭ই লিন্ডসে স্ট্রিটের ৪ এইচআর, গ্লোব মলে। পঞ্চম শোরুম হাওড়া এলাকার ৬২/২ রোজ মেরী লেনের রাঘব প্লাজা মলে। এর পাশাপাশি, বাংলাদেশের শোরুমের মতোই অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ক্যাম্বেলটাউনে ‘ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি শোরুম প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ওয়েবসাইটেও এই শোরুম উদ্বোধনের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এখন অস্ট্রেলিয়াতেও কার্যক্রম শুরু করেছে।

জানা গেছে, দিলীপের দাদির নাম পান্না দেবি। আর কাকার নাম পান্না আগরওয়ালা। দাদিকেই তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রেরণা হিসাবে মনে করে। কাকার নামেই প্রথম তাদের পারিবারিক ব্যবসা চালু করা হয়। কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুরে ছিল তাদের ‘পান্না সিনেমা হল’। পান্না মুভিজ নামে ছিল সিনেমা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। সিনেমা হলে কাজ করা দিলীপ কাকার হাত ধরেই ঢাকায় আসেন। এরপর যেন হাতে পান আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ। গড়ে তোলেন জুয়েলারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড। আর কলকাতায় দাদির নাম উৎসর্গ করে গড়ে তুলেছেন পান্না ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য দিলীপের ভাই পিন্টু কুমার আগরওয়ালা দেখভাল করেন। মূলত অর্থ পাচার, স্বর্ণ ও ডায়মন্ড চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতেই এসব শোরুম গড়ে তোলা হয়েছে।

জানা গেছে, শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিদেশে এসব শোরুম গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি দুদকের মামলায় বলা হয়েছে, দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ১১২ কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার ৪০৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং ৩৪টি ব্যাংক হিসাবে ৭৫৫ কোটি ৩০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬৩ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। তবে এসব সম্পদের তালিকায় বিদেশে বিনিয়োগের কোনো তথ্য নেই। আর তার স্ত্রী সবিতা আগরওয়ালার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, তিনি ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৭ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন এবং ৮টি ব্যাংক হিসাবে ২১৩ কোটি ২৮ লাখ ৭৩ হাজার ৯২৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক বছর আগে আলোচিত মডেল পিয়াসা ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তখন পুলিশ তার মাদক ব্যবসা ও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে পিয়াসা ও সহযোগী মিশুর সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখেছিল। তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের আশীর্বাদে দিলীপ ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পর গুলশান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। দিলীপের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরের উত্তরা পূর্ব, গুলশান, ধানমন্ডি, পল্টন ও মিরপুর থানায় সাতটি মামলা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় হত্যাসহ ফৌজদারি আইনে তার নামে মামলার সংখ্যা ডজনের বেশি। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যা, আন্দোলনবিরোধী শক্তিকে অর্থ জোগান দেওয়ার মতো অভিযোগেও এসব মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এরপরও সরকারের ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে দিলীপকে সব মামলায় জামিন ও গোপনে কারামুক্তির সুযোগ দিয়ে দেশের বাইরে পালানোর ব্যবস্থা করা হয়।

সব মামলায় জামিন নিয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর কঠোর গোপনীয়তায় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে যান দিলীপ। অজ্ঞাত কারণে এ সময় কোনো ধরনের গোয়েন্দা রিপোর্টও দেওয়া হয়নি। কারাগারে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরাও মুখ খোলেননি। নীরব ছিল কারা কর্তৃপক্ষও। কারাগার থেকে বেরিয়েই তিনি অবৈধ পথে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় চলে গেছেন বলে জানা গেছে। সরকারের প্রভাবশালী একজন আইন কর্মকর্তা দিলীপের গোপন মুক্তির নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ওই আইন কর্মকর্তা আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। দিলীপ তার নির্বাচনি খরচ চালাবেন বলে চুক্তি হয়েছে বলে গুঞ্জন আছে।

এসব বিষয়ে জানতে দিলীপ কুমার আগরওয়ালার একাধিক মোবাইল ফোন নম্বরে (হোয়াটসঅ্যাপ) কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে দিলীপের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আদালত তাকে জামিন দিয়েছেন। যথানিয়মে বেইলবন্ড কারাগারে পৌঁছানোর পর তিনি মুক্ত হন। এক্ষেত্রে অনিয়মের কিছু নেই।’ দেশত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার পাসপোর্ট জব্দ অবস্থায় আছে। ফলে তার বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি দেশেই আছেন।’

** দিলীপ কুমার আগরওয়ালা গোপনে কারামুক্ত
** ভেজাল হীরায় গড়ে উঠেছে দিলীপের সাম্রাজ্য
** ১৫ বছর ধরে হীরার বদলে কাচ বিক্রি করেছেন দিলীপ
** ১৫৮ কোটির অবৈধ সম্পদ ও লেনদেন ৯৬৯ কোটি
** বিদেশে টাকা পাচার: ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু
** ২৫,২০০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের!
** দেশে এত ডায়মন্ডের উৎস কোথায়

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!