আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) মনে করছে, স্থানীয় মুদ্রায় বা টাকায় বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করতে সরকারি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানো জরুরি। বন্ড মার্কেটের সুদের হার ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফার মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। যদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বন্ডের সুদের চেয়ে বেশি হয়, বিনিয়োগকারীরা বন্ড মার্কেটে আকৃষ্ট হবেন না এবং বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করার লক্ষ্য ব্যাহত হবে। এই তথ্য আইএমএফের প্রতিবেদন বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী বন্ড মার্কেট তৈরি করতে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে আইএমএফ। পাশাপাশি এগুলো সমাধানের সুপারিশ করেছে। আবার এসব সুপারিশের বিপক্ষে সরকারি সংস্থাগুলোর জোরালো যুক্তিও রয়েছে। তারপরও আইএমএফ বন্ডের একটি শক্তিশালী বাজার গড়ে তুলতে নানা শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুদহারের সমন্বয়। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হার সাড়ে ১০ শতাংশের নিচে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পৌনে ১২ শতাংশের ওপরে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার স্থির থাকতে পারবে না। বাজারভিত্তিক হতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, সঞ্চয়পত্রের লেনদেন ও সুদের হার এখনো বাজারভিত্তিক নয় এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও যথেষ্ট সচেতনতা নেই। ফলে এখনই পুরো বাজার কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফা প্রদানের ব্যবস্থা অনলাইনে আনা হলেও মুনাফা প্রদানের প্রক্রিয়া পুরোপুরি সহজ হয়নি। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, সরকারি খাতের ২ ও ৫ বছরের ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের ওপর ভিত্তি করে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা নির্ধারণ করতে হবে এবং প্রতি ছয় মাসে এই হার পরিবর্তন করতে হবে। গত ১ জুলাই থেকে নতুন হার কার্যকর হলেও এটি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের চেয়ে বেশি। আইএমএফের মতে, আগামী জানুয়ারি থেকে মুনাফার হার আরও কমানো প্রয়োজন। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণের চাহিদা অনেক বেশি। এখানে সরকারি খাত যেমন ঋণের বড় গ্রাহক, তেমনি বেসরকারি খাতও। কিন্তু ঋণের জোগান দেওয়ার মতো শক্তিশালী কাঠামো নেই। ঋণের চাহিদার জোগান দিতে স্থানীয় মুদ্রায় বন্ড বাজারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। শক্তিশালী বন্ডের বাজার গড়ে তুললে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ঋণের জোগান দেওয়া সহজ হবে। এতে বিনিয়োগ বাড়বে।
এদিকে সরকার সরাসরি জাতীয় সঞ্চয় থেকে ঋণ গ্রহণ করে। এসব ঋণ পরে অন্য খাতে স্থানান্তর করা যায় না। তা সরকারের সরাসরি ঋণ হিসাবেই থেকে যায়। আইএমএফ চাচ্ছে, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে যে ঋণ গ্রহণ করছে, একটি পর্যায়ে তা বন্ড মার্কেটে ছেড়ে দেবে। তখন ওইসব ঋণ মুদ্রা বাজার থেকে নেওয়া হবে। এর সুদের হারও থাকবে প্রতিযোগিতামূলক। সংস্থাটি মনে করে বাজারে টাকার সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতেই ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হোক। এতে বাজার টেকসই হবে। কোনো সমস্যা থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে দেখা দেবে। সরকার তা দ্রুত সমাধান করতে পারবে। কোনো সংকট চেপে থাকবে না। সরকারি খাতে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের নিলামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। আইএমএফ বলেছে, এসব নিলাম থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিরত থাকতে হবে। তাহলে বাজারের সক্ষমতা বুঝা যাবে। সরকারকে ঋণের জোগান দিতে গিয়ে বাজারে তারল্য সংকট হলে সুদের হার বেড়ে যাবে। তখন সরকার ঋণ কম নেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, এ ব্যাকরণ দিয়ে বাংলাদেশ চালানো খুব কঠিন। কারণ দেশে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যেমন কোনো ধারাবাহিকতা নেই, তেমনি সরকারি ব্যয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট ছক নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য যে কোনো সংকট হলে রাজস্ব আয় যেমন কমে যায়, তেমনি খরচ বেড়ে যায়। তখন সরকারের ঋণও বাড়ে। সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে ঋণের জোগান দেওয়া বাজারের পক্ষে কঠিন। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি বিল বন্ড কিনে পরে তা বাজারে ছেড়ে দেয়। ব্যাংকে তারল্যের জোগান কম থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়। বন্ড মার্কেট থেকে ঋণের জোগান নিতে গেলে খরচ বেশি পড়বে। এখান থেকে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা কেবল বড় শিল্প গ্রুপগুলোর রয়েছে। ছোট বা মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের নেই। বাংলাদেশে শিল্প খাতের ঋণের বেশির ভাগই যাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। যে কারণে বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করার বিষয়ে আইএমএফের সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বন্ড মার্কেট বড় হচ্ছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশ গ্রহণ উন্মুক্ত করা হলেও তাদের অংশগ্রহণ বাড়েনি।
** রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি, অব্যাহতি চাইতে হবে
** বাংলাদেশের বিদেশি ঋণে আইএমএফের সীমা নির্ধারণ
** আইএমএফের ১৩৩ কোটি ডলার ঋণ পেল বাংলাদেশ
** আইএমএফের ১.৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন
** আইএমএফ ঋণের কিস্তির সিদ্ধান্ত আসতে পারে ৫ মে
** বাংলাদেশকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেবে আইএমএফ!
** এনবিআর চায় শর্ত শিথিল, আইএমএফ’র না
** এনবিআর চায় শর্ত শিথিল, আইএমএফ’র না
** ঋণের দুই কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার ছাড়
** ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরাই যেন ভাতা পান
** লক্ষ্য কমিয়ে সমঝোতার পথে এনবিআর

