গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩,৪১০ জন মানুষ পাচারের শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সুশীল সমাজ এদের শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে ৭৬৫ জন যৌন পাচারের, ২,৫৭২ জন জবরদস্তি শ্রমের এবং ৭৩ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরে ১,৪৬২ জন পাচারের শিকার শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪৪ জন যৌন পাচারের, ২৮৫ জন জবরদস্তি শ্রমের এবং ১,০৩৩ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার। তবে সরকারি হিসাবেও এ সংখ্যা আগের বছরের ১,২১০ থেকে বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদন ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৫’-এ এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গত সোমবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টিয়ার-২ স্তরে রাখা হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এ স্তরে আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩০ হাজার কন্যাশিশু যৌন শোষণের শিকার হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের বৈধ-অবৈধ যৌনপল্লি এবং হোটেলগুলোতে শোষণ করা হচ্ছে। টিআইপি প্রতিবেদনে দেশগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়। টিয়ার-১-এ থাকে ন্যূনতম মান পূরণকারী দেশ। টিয়ার-২-এ রাখা হয় যারা পূর্ণমান পূরণে ব্যর্থ হলেও উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে (বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটান)। টিয়ার-২ ওয়াচলিস্টে রয়েছে নেপাল ও মালদ্বীপ। আর টিয়ার-৩-এ রাখা হয় ন্যূনতম মান পূরণে ব্যর্থ ও প্রচেষ্টা না নেওয়া দেশগুলোকে, যেখানে এ বছরও রয়েছে আফগানিস্তান।
টিআইপি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা রোহিঙ্গা পাচারে সহায়তা করেছিলেন। সেসব কর্মকর্তা পাচারকারীদের অর্থের বিনিময়ে ক্যাম্পে প্রবেশের সুযোগ করে দিতেন। এ ছাড়া চাঁদাবাজি ও হয়রানির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তারা।
ট্রাফিকিং ইন পারসন্স-২০২৫ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিশুশিশুদের দোকানদার, জেলে, রিকশাচালক ও গৃহকর্মী হিসেবে শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। কক্সবাজারে পর্যটকদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মেয়েদের যৌন শোষণ ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে, পাশাপাশি তাদের দিয়ে মাদক পাচার করানো হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে, কক্সবাজার ও ভাসানচর দ্বীপের ৩৩টি ক্যাম্পে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, ক্যাম্পে তদারকির ঘাটতি, দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ এবং সরকারের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠী, মিলিশিয়া ও সন্ত্রাসী সংস্থা শিশুসহ রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক কাজে নিয়োজিত করছে। একইসঙ্গে তারা পাচারের শিকারও হচ্ছেন, এবং বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শোষণের সম্মুখীন হচ্ছেন।
অভিযুক্তরা রোহিঙ্গা মেয়েদের বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া ও নেপালে যৌন পেশায় নিযুক্ত করার জন্য পাচার করে। কখনও কখনও চাকরি বা বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েও পাচার করে থাকে। বৈধ চাকরির ওপর সরকারি বিধিনিষেধে অনেক রোহিঙ্গা অবৈধ পথে অভিবাসন করছে। ফলে তাদের পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে।
৮১১ পাচার মামলা তদন্ত
সরকারের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ৩,৩৩৪ জন সন্দেহভাজনসহ ৮১১টি মানবপাচার মামলা তদন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৫টি যৌন পাচার, ২২৭টি শ্রম পাচার এবং ৪৬৯টি অন্যান্য ধরনের মামলা রয়েছে। এছাড়া পূর্ববর্তী প্রতিবেদনের সময়ের ৩৯৪টি মামলার তদন্ত এখনও অব্যাহত রয়েছে। আগে চার হাজার ৪২ সন্দেহভাজনসহ ৯৭৫টি মামলার তদন্ত চলছিল এবং ৫৩২টির তদন্ত অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছিল।
সরকারি তথ্যমতে, সব মিলিয়ে কমপক্ষে চার হাজার ৪৮৪টি মানব পাচার মামলা বিচারাধীন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এ ধরনের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল চার হাজার ৯৬০। সরকার এর আগে কক্সবাজারসহ কয়েকটি স্থানে অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনাল খোলার কথা ঘোষণা করেছিল। তবে এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ৪৫২ জন সন্দেহভাজনের বিচার শুরু করবে। পূর্ববর্তী প্রতিবেদনের সময়ের ৯৪ জনের বিচার এখনও চলছিল। এটি আগের প্রতিবেদনে তিন হাজার ৪৭৫ জনের বিচার শুরু হওয়ার তুলনায় কম। আদালত ও ট্রাইব্যুনাল ১০৩ জন পাচারকারীকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, যেখানে পূর্বে ৪০৭ জন দোষী সাব্যস্ত ছিলেন। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আদালত তিন মাসের বেশি সময় কার্যক্রম বন্ধ রাখায় আইন প্রয়োগে বাধা এসেছে। এছাড়া আদালত ৪৮ পাচারকারীকে সাজা দিয়েছেন।

