Header – Before
Header – After

এক কেজি আলুতে কৃষকের হাতে থাকছে ৬৮ পয়সা

মুন্সিগঞ্জের হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণ করে এবার পুরোপুরি লোকসানের মুখে পড়েছেন জেলার চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এক কেজি আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণে যেখানে খরচ হয়েছে ২৬ থেকে ২৮ টাকা, সেখানে হিমাগারে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮ টাকায়। হিমাগার ভাড়া ও শ্রমিক খরচ বাদ দিলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি আলুতে হাতে থাকছে মাত্র ৫২ থেকে ৬৮ পয়সা। স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছর বীজ, সার, জমি ভাড়াসহ উৎপাদন খরচ বেড়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তাতে এক কেজি আলু উৎপাদনে ১৭–১৯ টাকা, বাছাই ও প্যাকেজিংয়ে তিন টাকা এবং হিমাগারে সংরক্ষণে আরও ছয় টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু হিমাগারে এক কেজি আলুর পাইকারি দাম এখন ৮ টাকা। এই দামেও ক্রেতা মিলছে না।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরকেওয়ার ইউনিয়নের হামিদপুর এলাকার কিষানি সাহারা বেগম বলেন, ‘আমাদের অন্য কোনো কাজ জানা নেই। স্বামী স্ট্রোক করার পর তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নিজেই ৩ একর ২০ শতাংশ জমিতে আলু চাষ করেছি। এ জন্য প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ধারদেনা করতে হয়েছে। উপযুক্ত দামে আলু বিক্রি না হওয়ায় সব ঋণের বোঝা এখন ঘাড়ে রয়ে গেছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মুন্সিগঞ্জ জেলায় ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। আর আলু উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৮২ হাজার ৫৩৮ মেট্রিক টনের বেশি। এর মধ্যে ৬১টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন আলু। বিক্রির পর এখনো মজুত আছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন। এই আলুর মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৫ মেট্রিক টন খাওয়ার আলু, বাকি ৯৭ হাজার ২৫ মেট্রিক টন বীজ হিসেবে রাখা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে মজুত ছিল মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৭ মেট্রিক টন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আলু চাষ মুন্সিগঞ্জের কৃষকদের আবেগ ও ঐতিহ্যের অংশ। দাম কমলেও তাঁরা আলু উৎপাদন বন্ধ করেন না। সরকার ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি বাস্তবায়িত হলে কৃষকেরা টিকে থাকতে পারতেন। যতটুকু জানি, সরকার সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, কৃষকদের বাঁচাতে আলু রপ্তানির উদ্যোগ ও আলুভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সূর্যমুখী ও মৌসুমি সবজি চাষে মুন্সিগঞ্জের কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

৫০ কেজির একটি আলুর বস্তা বাছাইয়ের পর থাকে ৪৮ কেজি। কেজিপ্রতি ৮ টাকা হিসেবে বস্তাটির বিক্রি মূল্য দাঁড়ায় ৩৮৪ টাকা। এর মধ্যে হিমাগার ভাড়া ৩০০ টাকা এবং কেজিপ্রতি শ্রমিক খরচ ১ টাকা হিসেবে মোট ব্যয় বাদ দিলে প্রতি বস্তায় হাতে থাকে মাত্র ৩৪ টাকা—অর্থাৎ কেজিপ্রতি আয় ৬৮ পয়সা। সম্প্রতি সরেজমিনে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরের এলাইড কোল্ডস্টোরেজ, বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস, দেওয়ান কোল্ডস্টোরেজ ও কদমরসূল কোল্ডস্টোরেজে গিয়ে দেখা যায়, হিমাগারগুলো প্রায় নিস্তব্ধ। প্রতিটি কোল্ডস্টোরেজে কয়েকজন শ্রমিক কেবল আলু বাছাইয়ের কাজ করছিলেন।

গত আগস্টে হিমাগারে আলু বিক্রি হচ্ছিল সাড়ে ১২ থেকে ১৩ টাকায়। তখন কৃষকদের প্রায় অর্ধেক লোকসান হচ্ছিল। এ রকম অবস্থায় ২৭ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় হিমাগারে আলুর দাম সর্বনিম্ন ২২ টাকা নির্ধারণ করে এবং ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু সরকারি উদ্যোগে কেনার ঘোষণা দেয়। সে সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতি কেজি আলুর দাম ২২ টাকা উল্লেখ করে হিমাগারের সমানে ব্যানার টানিয়ে দেয়। এতে হিমাগারে আলু রাখা কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আশাবাদী হয়ে ওঠেন। কিন্তু বাস্তবে সরকারের কোনো ঘোষণাই কার্যকর হয়নি; অর্থাৎ ২২ টাকা কেজিতে আলু যেমন বিক্রি হয়নি, তেমনি সরকারিভাবেও ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু কেনা শুরু হয়নি।

ব্যবসায়ী বাবুল পাইক বলেন, সরকারি ঘোষণার পর দাম বাড়ার আশায় অনেকে আলু বিক্রি বন্ধ করে দেন। কেউ কেউ ১৩–১৪ টাকায়ও কেজিতে আলু কিনে রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সরকার আলু না কিনে সবাইকে বিপদে ফেলে দিয়েছে।

মুন্সিগঞ্জের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুল হক বলেন, ‘সরকার ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে কোনো ক্রয় হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ যোগাযোগ করেননি। এখন দিন দিন দাম কমছে। নভেম্বরেই নতুন আলু বাজারে আসবে, তখন পুরোনো আলুর চাহিদা থাকবে না।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!