মাত্র এক বছর আগে শেয়ারদর ১০০ টাকার নিচে থাকা শ্যামপুর সুগার মিলসের শেয়ার এখন ২০০ টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন ও কারখানা বন্ধ থাকলেও আর্থিক কোনো সূচক ভালো নয়, ঋণের বোঝা ভারী। এমন অস্বাভাবিক উল্লম্ফন নিয়মিত ঘটছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কারণ জানতে চাওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটি কোনো তথ্য দেয়নি। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই উচ্চ শেয়ারদরে কারসাজির ছায়া আছে।
খোঁজে দেখা গেছে, গত দুই সপ্তাহ ধরে শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড টপ গেইনার ও টপ ব্লক ট্রেডের শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবস্থান করছে। ১৪ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর এটি টপ টেন গেইনারে দ্বিতীয় স্থানে ছিল, আর ২১-২৫ সেপ্টেম্বর টপ টেন ব্লক ট্রেডে অষ্টম স্থানে অবস্থান নিয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কারখানা ও উৎপাদন ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে বন্ধ। রিজার্ভ শূন্য, রিটেইন্ড আর্নিংয়ে ঘাটতি ৬৪০ কোটি টাকার বেশি, এবং দায়ের পরিমাণ ৩৭৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শেয়ারপ্রতি আয় ঘাটতি ৪৮.৮৪ টাকা এবং শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য প্রায় ১,২৬০ টাকা কম। তবু শেয়ারদর হু হু করে বাড়ছে। গত এক বছরে শেয়ারদরের সীমা ৮৩ থেকে ২২২ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে; সর্বশেষ বুধবার শেয়ারদর ছিল ২০৬ টাকা। মাত্র ৫ কোটি টাকার লো-পেইডআপ কোম্পানির এমন বৃদ্ধি স্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে মনিটরিং ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর শ্যামপুর সুগারের সমাপ্ত দর ছিল ৯০ টাকার ঘরে। এমনকি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি অধিকাংশ সময় পর্যন্ত এটি ৯০ এর ঘর পেরোতে পারেনি। কিন্তু মার্চ মাসের ১০ তারিখের পর থেকেই যেন শেয়ারদর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে সর্বোচ্চ দর ওঠে ২০৮.৩০ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৭ মাসেই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩০ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির হঠাৎ এই অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর ডিএসই’র পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। এমনকি গত মার্চ মাসে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির শুরুতে কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি কোনো তথ্য দিতে পারেনি। একইভাবে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি এবং তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরেও ডিএসই চিঠি পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বাজার বিশ্লেষকরা ভিন্ন মন্তব্য করছেন। তাদের মতে, মাত্র পাঁচ কোটি টাকা পেইডআপের এই কোম্পানির ফ্রি ফ্লট শেয়ারের পরিমাণ ৪৯ শতাংশ, যা প্রায় অর্ধেক। এটি বাজার কারসাজিতে জড়িতদের জন্য লোভনীয়। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট ক্যাপ থেকেও এই অবস্থা বোঝা যায়। মাত্র পাঁচ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির বাজার মূল্য বর্তমানে ১০৩ কোটি টাকা, যেখানে ২১ আগস্টে এটি ছিল ৭৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। দুই মাসে বাজার মূলধন ২৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করা দুষ্কর।
ডিএসই’র তথ্যে দেখা যায়, পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত দুর্বল কোম্পানি শ্যামপুর সুগার মিলসের সম্পদমূল্য নেগেটিভ। কোম্পানিটি ডুবেছে লোকসানে। রিজার্ভও নেগেটিভ। তবুও গত ২০ কর্মদিবসে লাফিয়ে লাফিয়ে শেয়ারটির দর বেড়েছে ৫১ টাকা। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে রেগুলেটরদের দৃষ্টি দিতে বলছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে (২০২৪-২০২৫) তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) আর্থিক প্রতিবেদনে শ্যামপুর সুগার মিলসের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৪ টাকা ৯৬ পয়সা। আগের বছরের (২০২৩-২০২৪) একই সময়ে (জানুয়ারি-মার্চ) শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ১০ টাকা ৬৭ পয়সা। কোম্পানিটির গত অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩৮ টাকা ২৯ পয়সা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-মার্চ) শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৩১ টাকা ৭৫ পয়সা। গত তিন প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ হয়েছে ৯ পয়সা। গত ৩১ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৯৮ টাকা ২১ পয়সা।
এর আগে, ২০২৩-২০২৪ সমাপ্ত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) জন্য বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ওই অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছিল ৪৮ টাকা ৮৪ পয়সা। ওই সমাপ্ত বছরে শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ হয়েছিল নেগেটিভ ৫৫ টাকা ২২ পয়সা। শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছিল নেগেটিভ এক হাজার ২৫৯ টাকা ৯২ পয়সা।১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় শ্যামপুর সুগার মিলস। ‘জেড’ ক্যাটাগরির এই কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকা। শেয়ার সংখ্যা ৫০ লাখ। রিজার্ভ রয়েছে নেগেটিভ ৬২৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার সরকারের হাতে ৫১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে পাঁচ দশমিক ২৯ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ রয়েছে।
জেড ক্যাটাগরিভুক্ত ও আর্থিক বেহাল দশার পরও এমন উচ্চ শেয়ারদরের বিষয়ে সরাসরি কোম্পানিকে দায়ী করেছেন পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, জেড ক্যাটাগরিতে থাকার পরও অনেক কোম্পানির শেয়ারদর আকাশচুম্বি, এগুলোর সঙ্গে সরাসরি কোম্পানি জড়িত। সাকিব-হিরু-সাইফুল গংদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে তারা শেয়ার দর বাড়ায়।

