রাজশাহীতে এ বছর এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ৯ থেকে ১০ টাকা। বাছাই করে হিমাগারে সংরক্ষণের উপযোগী করতে কেজিপ্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগার ভাড়া কেজিতে ছয় টাকা, আর বস্তা, পরিবহন ও শ্রমিক খরচ মিলিয়ে আরও তিন থেকে চার টাকা যোগ হয়েছে। ফলে হিমাগারে এক কেজি আলু সংরক্ষণে মোট খরচ হয়েছে অন্তত ২৫ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণের পাঁচ মাস পর এখন সেই আলু হিমাগারে পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১১ টাকায়। এতে কৃষকদের কেজিপ্রতি প্রায় ১৫ টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে। একইভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন আলু কিনে মজুত করা ব্যবসায়ীরাও।
জেলার আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হিমাগারে রাখা আলু এখন বোঝায় পরিণত হয়েছে। দাম বাড়ার আশায় সংরক্ষণ করলেও এখন মৌসুমের চেয়ে অনেক কম দামে কেজিপ্রতি ১০–১১ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে, যেখানে গত বছর একই আলুর দাম ছিল ৪০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে স্থানীয় খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ২০–২৫ টাকা কেজি দরে। ফলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। ক্ষেত থেকে শুরু করে হিমাগার পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। সরকারের আলু কেনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় চাষিদের হতাশা আরও বেড়েছে। এভাবে দাম কমে গেলে আগামী মৌসুমে চাষে অর্থ সংকটে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৩০ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এটি জেলার বার্ষিক চাহিদা এক লাখ ১৩ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টনের তুলনায় প্রায় নয় গুণ বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার তিন হাজার ৫৪৫ হেক্টর বেশি জমিতে বেশি চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদন বেড়েছে ৯১ হাজার ৬৯৩ মেট্রিক টন। এই অতিরিক্ত উৎপাদন বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দরপতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যমতে, রাজশাহীতে ৩৯টি হিমাগারের মধ্যে ৩৭টি সচল, যেখানে মোট ধারণক্ষমতা চার লাখ ৩৩ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। এবার চার লাখ ৩৪ হাজার ৪৯১ মেট্রিক টন আলু মজুত করা হয়, যার মধ্যে তিন লাখ ৬০ হাজার ৭৩২ মেট্রিক টন খাওয়ার এবং ৭৩ হাজার ৭৫৯ মেট্রিক টন বীজ আলু। বর্তমানে প্রায় দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৮৬ মেট্রিক টন মজুত আছে। কিন্তু বাজারে দাম এতই কম, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আলু তোলার খরচ তুলতে পারছেন না। ফলে হিমাগারে মজুত আলু বের করছেন না তারা।
তানোর উপজেলার কৃষক মোজাম্মেল হক টুটুল আলু সংকটের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি ১৬৪ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে ৯ হাজার ৩৪৮ বস্তা আলু উৎপাদন করেছেন, যার পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় এক কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সরকারের আলু কেনার ঘোষণার আশায় তিনি দুই হাজার বস্তা আলু বিক্রি না করে হিমাগারে সংরক্ষণ করেন। তবে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়া এবং দাম ধসে পড়ায় সেই আলুগুলো এখনো হিমাগারেই পড়ে আছে। হতাশা প্রকাশ করে মোজাম্মেল হক বলেন, সরকার বলেছিল আলু কিনবে, কিন্তু এক বস্তাও কেনেনি। ভেবেছিলাম সরকার কিনলে কিছুটা লোকসান কমবে, তাই হিমাগারে রেখেছিলাম। এখন লোকসানে ডুবে আছি। এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে কৃষকেরা আলু চাষে আগ্রহ হারাবে।
গত আগস্ট মাসে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, হিমাগার গেটে আলুর কেজিপ্রতি সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। আর দাম কমে যাওয়ায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু কিনবে সরকার, যা আগামী অক্টোবর ও নভেম্বরে বিক্রি করা হবে। কিন্তু কৃষক ও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, এই প্রতিশ্রুতি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ১০-১১ টাকা কেজি দরেই বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিঠু হাজী বলেন, ‘প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের ৯-১০ টাকা খরচ হয়েছে। হিমাগারে রাখার উপযোগী করতে দাম পড়েছে ১৫ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগারভাড়া দিতে হয়েছে ছয় টাকা। সবমিলিয়ে কেজিতে ২৫-২৬ টাকা খরচ হয়েছে। এখন ১০-১১ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই লোকসান থেকে উঠে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব কৃষকদের। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখেনি। এক কেজিও কেনেনি। আমরা এখন কী করবো? সমাধানের পথ কার কাছে পাবো।’
জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আহাদ আলী দরপতনের তিনটি কারণ জানিয়েছেন। সেগুলো হলো- অধিক আলু উৎপাদন, হিমাগারে পচে যাওয়া এবং দাম কম পাওয়া। তিনি বলেন, ‘এক কেজির উৎপাদন খরচ, হিমাগার ভাড়া ও পরিবহন খরচসহ প্রায় ২৫-২৬ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১০-১১ টাকায়। পাইকারিতে দাম কম হওয়ায় হিমাগার থেকে আলু বাজারে নেওয়ার খরচ-ই উঠছে না। অনেকে আলু হিমাগার থেকে তুলতে পারছেন না। এতে প্রতি কেজিতে ১৫-১৬ টাকা লোকসান হচ্ছে।’
