Header – Before
Header – After

আলুর দামে পতন, ব্যাপক ক্ষতির মুখে কৃষকরা

দেশের আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা এবার মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়েছেন। মৌসুম শেষে বাজারে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না অনেকেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত উৎপাদন, রপ্তানি বাজারের সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনাই এ সংকটের মূল কারণ। বগুরার নন্দীগ্রাম উপজেলার কুন্দারহাটের কৃষক আব্দুল হালিমের অভিজ্ঞতা যেন পুরো পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি। তিনি ২৬ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। মৌসুমের শুরুতে দাম কম থাকায় পুরো ফসল হিমাগারে মজুত করেন তিনি।

প্রতিটি কেজি আলুতে তার মোট খরচ পড়েছে ২৮ টাকা—এর মধ্যে ১৮ টাকা উৎপাদন ব্যয় এবং কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া, শ্রমিক, পরিবহন, বস্তা ও কর বাবদ আরও ১০ টাকা। কিন্তু মৌসুমের শেষে এসে কোল্ড স্টোরেজ গেইটে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৯-১০ টাকায়। বাধ্য হয়ে তাকে কম দামেই আলু বিক্রি করতে হয়েছে। এতে লাভের বদলে উল্টো ১৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে এ কৃষকের।

হালিম বলেন, ‘জুনের শুরুতে কেজিপ্রতি ১৮ টাকায় বিক্রি করতে পেরেছিলাম। কিন্তু পরে ৯–১০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে দাম বেশি ছিল। এখন যারা বিক্রি করছে, তারা অন্তত ১৮–২০ টাকা লোকসান দিচ্ছে, তাও ক্রেতা নেই।’ ‘এত বড় ক্ষতি আমি কখনও দেখিনি। আগামী বছর এত জমিতে আর আলু চাষ করতে পারব না। এবছর আলু করে সব টাকা পয়সা হারিয়ে ফেলেছি’, বলেন তিনি।

দেশজুড়ে প্রায় সব আলুচাষি ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখন একই সংকটে রয়েছেন। মৌসুমের শুরুতে যারা আলু বিক্রি করেছেন, তাদের কেজিপ্রতি ৪ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হয়েছে। আর যারা হিমাগারে মজুত রেখেছেন, তাদের ক্ষতি আরও বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে ৪.৬৭ লাখ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৪ থেকে ১৭ টাকা। বর্তমানে ঢাকার খুচরা বাজারে আলুর দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা, আর কারওয়ান বাজারে পাইকারি দাম ১২ টাকা।

অন্যদিকে, সরকার নির্ধারিত আলুর দর প্রতি কেজি ২২ টাকা। কিন্তু দেশের বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি মাত্র ৮–১০ টাকায়। নিম্নমানের আলু বিক্রি হচ্ছে ৪–৬ টাকায়, তাতেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। বগুরার খন্দকার সিড কোল্ড স্টোরেজে সোমবার সকালে এক ব্যবসায়ীকে কাঁদতে দেখা যায়। গুদামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন সাজু জানান, ওই ব্যবসায়ী গাইবান্ধা থেকে ২০ লাখ টাকার আলু মজুত করেছিলেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য এখন মাত্র ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অধিকাংশ আলু পচে গিয়ে খাওয়ার অযোগ্য। এখন শুধু গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৯০ লাখ টন, আর গুদাম ধারণক্ষমতা ৪৫ লাখ টন। গত সোমবার পর্যন্ত ৩৪০টি গুদামে প্রায় ২০ লাখ টন আলু মজুত ছিল, যার মধ্যে ১১ লাখ টন টেবিল আলু ও ৯ লাখ টন বীজ আলু। বগুরা, জয়পুরহাট ও রংপুরের গুদাম মালিকদের তথ্যমতে, সাধারণত এ সময়ের মধ্যে ৭০ শতাংশ আলু বিক্রি হয়ে যায়, কিন্তু এবার বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। বগুরার শেরপুরের আগ্রো আর্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘দাম না থাকায় কৃষকেরা গুদাম থেকে আলু তুলছেন না। এখনও ৭০ শতাংশ আলু বিক্রি হয়নি।’

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বর্তমান পরিস্থিতিকে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, শুরু থেকেই পরিষ্কার ছিল—এ বছর আলুর উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হবে, ফলে দামের পতন অনিবার্য ছিল। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতেই সরকারকে অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টন আলু ক্রয় করা উচিত ছিল। আমরা সে সময়ই এই সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সরকার শেষে এসে মাত্র ৫০ হাজার টন কেনার ঘোষণা দিয়েছে, যা একেবারেই অপ্রতুল। তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টন। উৎপাদন এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানি বাড়াতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। শুরু থেকেই বিষয়টি গুরুত্ব দিলে আজকের এই সংকট তৈরি হতো না।

গত ২৭ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় ঠান্ডা গুদাম গেটে আলুর ন্যূনতম দাম কেজিপ্রতি ২২ টাকা নির্ধারণ করে এবং অক্টোবর–নভেম্বরে ৫০ হাজার টন আলু কিনে সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হয়নি। সরকার না দাম নিশ্চিত করেছে, না আলু কিনেছে। বরং ঘোষণার পর চাষিরা আলু তোলা স্থগিত রেখেছিলেন, আশায় যে সরকার কিনবে—ফলে বাজারে সরবরাহ কমে দাম আরও পড়ে যায়।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন এখন ক্ষতিগ্রস্ত আলু চাষিদের জন্য প্রণোদনা দাবি করেছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জোর দিয়ে বলেছেন, আলুর আবাদ মৌসুম দ্রুত এগিয়ে আসছে। অক্টোবরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের প্রতিশ্রুত প্রণোদনা না দিলে তা কোনো কাজে আসবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমান লোকসানের কারণে কৃষকদের কাছে পরবর্তী চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক কেনার মতো অর্থ নেই।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!