দেশের সীমান্তবর্তী ও দুর্গম টেকনাফ শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে নদীপথে আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম চলে। তবে পদ্ধতিগত ও আইনগত ত্রুটির কারণে এখানে নিয়মিত অনিয়ম ও রাজস্ব ফাঁকি ঘটছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের ভাষায় লেখা আমদানি পণ্যের তালিকা কাস্টমস কর্মকর্তারা বুঝতে না পারায় যাচাই–বাছাইয়ের সুযোগ সীমিত। এ ছাড়া আমদানি ব্যাংক ড্রাফটের সীমা ও রপ্তানি ড্রাফটের সীমার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি দাখিলের কাজ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বদলে করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। পণ্য পরিবহনের জলযানে আইজিএম থাকলেও রোটেশন নম্বর থাকে না। পচনশীল পণ্য ওয়্যারহাউসে না রেখে সরাসরি ট্রাকে বোঝাই করার সুযোগে মিথ্যা ঘোষণা ও নিষিদ্ধ পণ্য আমদানির পথ খুলছে।
পণ্য খালাসের নির্দিষ্ট সময় না থাকায় কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতেও সন্ধ্যা বা রাতে খালাস চলছে। বন্দরের বেশির ভাগ স্থানে নেই সিসি ক্যামেরা বা স্ক্যানার। রপ্তানি পণ্যও পরীক্ষা করা হয় না। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব সফটওয়্যারে তথ্য সংরক্ষণ করে, যা কেন্দ্রীয় নজরদারির আওতায় নেই। এভাবে কাস্টমস ও বন্দরের নানা ত্রুটি ও নজরদারির অভাবে টেকনাফ শুল্ক স্টেশনে অনিয়ম ও রাজস্ব ফাঁকি দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি এসব অনিয়ম ও রাজস্ব ক্ষতির কারণ অনুসন্ধান করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ‘টেকনাফ শুল্ক স্টেশনে আমদানি–রপ্তানি কার্যপ্রণালির পদ্ধতিগত ত্রুটি ও রাজস্ব ফাঁকি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সম্প্রতি কয়েকটি রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।
প্রতিবেদনে টেকনাফ শুল্ক স্টেশনে আমদানির ক্ষেত্রে পাঁচটি, রপ্তানির ক্ষেত্রে দুটি, এবং বন্দর ব্যবস্থাপনায় ছয়টি ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব সমস্যা সমাধানে দশটি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ড্রাফটের সীমা সংক্রান্ত ত্রুটিকে। এতে বলা হয়েছে, আমদানি নীতি ২০২১–২৪ অনুযায়ী মিয়ানমার থেকে একক চালানে ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের পণ্য—যেমন চাল, ডাল, ভুট্টা, ছোলা, আদা, রসুন, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, পেঁয়াজ ও মাছ—আমদানি করা যায়। অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে এ সীমা ৩০ হাজার ডলার নির্ধারিত।
অন্যদিকে, টেকনাফ স্টেশন দিয়ে রপ্তানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের ২০০৩ সালের একটি স্থায়ী আদেশ কার্যকর রয়েছে। সেই অনুযায়ী, পচনশীল পণ্যের জন্য ব্যাংক ড্রাফটের সীমা ১৫ হাজার ডলার এবং অন্যান্য পণ্যের জন্য ৫ হাজার ডলার। অর্থাৎ, রপ্তানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ডলারের সীমা প্রযোজ্য।
প্রতিবেদনে এ স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ১০টি ত্রুটি বা সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হলো আইজিএম সমস্যা। জলযানের মাস্টারের কাছে মিয়ানমারের স্থানীয় ভাষায় লেখা পণ্যের তালিকা ছাড়া কোনো আইজিএম, বোট নোট থাকে না। দ্বিতীয় সমস্যা রোটেশন বা আইজিএম নম্বর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদেশ অনুযায়ী কাস্টমস কর্মকর্তা রোটেশন বা আইজিএম নাম্বার দেন। একটি জলযানের ক্ষেত্রে একটি রোটেশন বা আইজিএম নম্বর হওয়ার কথা। বাস্তবে দেখা গেছে, স্টেশনের আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের কাছে একাধিক রোটেশন বা আইজিএম নম্বর রয়েছে। পণ্য ওয়্যারহাউসকরণ সমস্যা রয়েছে। অপরদিকে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের দাখিল করা বিল অব এন্ট্রি কাস্টমস কর্মকর্তা অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে দাখিল করে থাকেন। তবে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে প্রবেশ করে বিল অব এন্ট্রি দাখিলে কোনো ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়নি। জলযান বহির্গমনের অনুমতি নেয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, জলযানকে বহির্গমনের অনুমতি দেবেন কাস্টমস কর্মকর্তা। কিন্তু এ স্টেশনে বহির্গমনের কোনো অনুমতিপত্র দেয়ার কার্যক্রম দেখা যায়নি।
অপরদিকে আমদানি প্রক্রিয়ায় এ স্টেশন দিয়ে রাজস্ব ঝুঁকির পাঁচটি বিষয় তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের স্থানীয় ভাষায় লেখা পণ্যতালিকা স্বাভাবিকভাবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে দুর্বোধ্য। পরবর্তীকালে আমদানিকারকের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জলযানের পণ্যতালিকা অনুযায়ী প্রস্তুত করা আইজিএমের তিন কপি রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে দাখিল করেন। এতে স্বাভাবিকভাবে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দরে আমদানি করা পণ্যের বর্ণনায়, সংখ্যায়, ওজন ও পরিমাণে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির সম্ভাবনা তৈরি হয়। আরও বলা হয়, জলযানে পরিবাহিত পণ্য এবং তার ভিত্তিতে প্রস্তুত করা আইজিএম আমদানিকারকরা তাদের আমদানি চালান বা চূড়ান্ত আইজিএম হিসেবে দাখিল করতে চান না। তাদের যুক্তি হচ্ছে, তারা যে বর্ণনার এবং পরিমাণের পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংক ড্রাফট গ্রহণ করেন, মিয়ানমারের স্থানীয় আমদানিকারকরা সে বর্ণনার ও পরিমাণের পণ্য একেবারে সরবরাহ করতে পারেন না। কাস্টমস আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও এ স্টেশনের কাস্টমস কর্মকর্তা এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের যুক্তি মেনে নিয়ে বিভিন্ন সময় আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য চালানকে একক পণ্য চালান হিসেবে বিল অব এন্ট্রিতে সমন্বয় করেন। এতে পণ্যের বর্ণনায়, সংখ্যায় ও পরিমাণে মিথ্যা ঘোষণাসহ ঘোষণা ছাড়াই বন্দর থেকে পণ্য খালাসের সম্ভাবনা থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একক একটি জলযানে পরিবাহিত পণ্যের জন্য আমদানিকারক বা সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিভিত্তিক একাধিক রোটেশন বা আইজিএম নম্বর আইনের ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সামগ্রিক শুল্ক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা ও রাজস্ব ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এতে শুল্ক ব্যবস্থাপনায় রাজস্ব ফাঁকির ঝুঁকি কমানোর জন্য পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট, যেকোনো অনিয়ম বা রাজস্ব ফাঁকি হওয়ার পরবর্তীকালে যথাযথ তদন্ত পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তাদের অ্যাসাইকুডায় বিল অব এন্ট্রি দাখিল কাস্টমস আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে অনিয়ম ও রাজস্বফাঁকি-সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তিতে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। অপরদিকে আমদানি করা পচনশীল পণ্যের পরীক্ষণ, শুল্কায়ন ও খালাসের বিষয়ে স্থায়ী আদেশে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। পচনশীল পণ্য সরাসরি জলযান থেকে খালাসের জন্য ট্রাকে বোঝাই করা হয় বিধায় মিথ্যা ঘোষণাসহ নিষিদ্ধ পণ্য আমদানির ঝুঁকি থেকে যায়। প্রতিবেদনে রপ্তানির ক্ষেত্রে দুটি ঝুঁকির বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, এ স্টেশনে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নজরদারি করা হয় না। রপ্তানি পণ্য বন্দরে প্রবেশ, ওজন পরিমাপ থেকে জাহাজীকরণ পর্যন্ত কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া পণ্য যথাযথভাবে পরীক্ষণ করা হয় না। রপ্তানি পণ্য ওয়্যারহাউসে সংরক্ষণ না করে সরাসরি জাহাজীকরণ করা হয়।
প্রতিবেদনে বন্দর ব্যবস্থাপনায় ছয়টি ত্রুটি তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ওয়্যারহাউসে পণ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ ও খালাস কার্যক্রম রেজিস্টার বইয়ে পণ্যের বর্ণনা, সংখ্যা ও পরিমাণের মাধ্যমে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হয়। ওয়্যারহাউসের পণ্যের বর্ণনা আর আইজিএমের বর্ণনায় গরমিল পাওয়া গেছে। সঠিক পদ্ধতিতে পণ্য সংরক্ষণ করা হয় না। পণ্য খালাসের জন্য নেই কোনো রেজিস্টার। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষকে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে প্রবেশের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্য চালানের এক্সিট দেয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সফটওয়্যারে পণ্যের এক্সিট দেয়া হয়ে থাকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমদানি নীতিতে পচনশীল পণ্যে ৫০ হাজার ডলার এবং বাণিজ্যিক পণ্যে ৩০ হাজার ডলার মূল্যের ব্যাংক ড্রাফটের বিধান থাকায় আমদানিকারকরা সাধারণত একটি ব্যাংক ড্রাফটের বিপরীতে একটি বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন। পণ্য চালানের মূল্যের তুলনায় ব্যাংক ড্রাফটে ডলারের পরিমাণ বেশি হওয়ায় একটি ড্রাফটের বিপরীতে পণ্যের পরিমাণও বেশি হয়, যা একই সময় বন্দরে আসে না। এক্ষেত্রে একই সঙ্গে সব পণ্যের এক্সিট হয় না। ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সফটওয়্যার থেকে ধাপে ধাপে পণ্যের এক্সিট কাটা হয় এবং বাকি অংশে ব্যালেন্স হিসেবে থাকে। পরবর্তী সময়ে ওই বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে পণ্য চালান এলে আবার ব্যালেন্স এক্সিট কাটা হয় এবং ধাপে ধাপে একপর্যায়ে সম্পূর্ণ পণ্য চালান খালাস করা হয়। ফলে অনিয়ম ও শুল্ক ফাঁকির মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে।
এ স্টেশন ও বন্দরের অনিয়ম এবং রাজস্ব ফাঁকি রোধে ১৫টি সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রপ্তানির ব্যাংক ড্রাফটের সীমা পরিবর্তন করে আমদানি ব্যাংক ড্রাফটের সমপরিমাণ করা; আইজিএমে মিয়ানমারের ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার; মিথ্যা ঘোষণার পণ্য রোধে একটি জলযানে আমদানি পণ্য একবার চূড়ান্ত বিল অব এন্ট্রি দাখিল; একটি জলযানের জন্য একটি রোটেশন বা আইজিএম নাম্বার চালু; ওয়্যারহাউস সম্পূর্ণ অটোমেশন; বিল অব এন্ট্রি দাখিলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড প্রদান; কাস্টমস কর্মকর্তাদের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি; রপ্তানি পণ্য যাচাই; বন্দর পুরোপুরি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা; স্ক্যানার স্থাপন; ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করতে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা; পণ্য খালাসের নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেয়া; অ্যাসাইকুডার সঙ্গে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের সফটওয়্যারের সমন্বয় করা এবং স্থায়ী আদেশ সংশোধন করা।

